সুপবন বহিতেছে। পতাকা উড়াইয়া দাও। তাহাতে নাম লিখ: জেমস মাইকেল লিংডো। সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি কলেজ যে তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করিল, তাহার প্রেক্ষিতে বহমান পবনের সু-ত্ব লহিয়া কেহ প্রশ্ন তুলিতেই পারেন। সত্য, ইহা বড় সুখের সময় নহে। শিক্ষার সহিত ন্যূনতম সম্পর্কহীন কিছু বহিরাগতের হাতে ঐতিহ্যমণ্ডিত বেকার ল্যাবরেটরি তছনছ হইতেছে, দৃশ্যটি হৃদয়বিদারক। কিন্তু, পরিবর্তনের সুযোগ সর্বদা সুসময়ের অপেক্ষাতেই থাকে না সাক্ষী জুলাই ১৯৯১। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডব পশ্চিমবঙ্গকে তেমনই এক মুহূর্তের সম্মুখীন করিয়াছে। রাজ্য এক ঐতিহাসিক সুযোগের দোরগোড়ায়। প্রেসিডেন্সিতে কাহারা হামলা চালাইল, তাহা এখনও তদন্তাধীন। হামলার উদ্দেশ্য সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের দখল লওয়া। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ যে নামেই ছাত্রদের, প্রকৃতার্থে তাহা বৃহত্তর রাজনীতির কাঁচামাল নির্মাণের কারখানা। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল পাইলে একটি গৌরবান্বিত কারখানার মালিক হওয়া যায় বটে। এই প্রেক্ষিতে দেখিলে বুধবারের ঘটনাক্রম অতি প্রত্যাশিত ছিল। তাহাতে অনপনেয় ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। কিন্তু একটি লাভও হইয়াছে পরিবর্তনের সুপবন বহিবার বাতায়নগুলি খুলিয়া গিয়াছে। বঙ্গ-রাজনীতির এই অসহ অধঃপতন যদি সরকারের অন্তরে কিছুমাত্র আঘাত করিয়া থাকে, তবে পরিবর্তনের তাগিদ অনুভূত হইতে বাধ্য। প্রসাধনাত্মক পরিবর্তন নহে, আমূল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। রাজ্য প্রশাসনের সৌভাগ্য, সেই পরিবর্তন কোন পথে সাধিতে হইবে, তাহার মানচিত্র ইতিমধ্যেই এক জন আঁকিয়া দিয়াছেন। তিনি জেমস মাইকেল লিংডো।
ছাত্র সংগঠনগুলিকে দলীয় রাজনীতি হইতে বিচ্ছিন্ন করাই সেই পরিবর্তনের মূল সুর। ‘ছাত্র রাজনীতি’ বাক্যবন্ধটিতে রাজনীতি অপেক্ষা ছাত্রের গুরুত্ব অধিক হওয়াই বিধেয়। এবং, নামমাত্র ছাত্র নহে, প্রকৃত ছাত্র, যাহারা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকে, এবং পরীক্ষায় ভাল নম্বর পায়। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র রাজনীতির ছবিটি কল্পনা করিলে এই প্রস্তাব অলীক বোধ হওয়া স্বাভাবিক। দীর্ঘ অনাচারের ফলে কলেজের ইউনিয়ন রুমগুলি পার্টি অফিসে পরিণত হইয়াছে। এই ছবিটি পরিবর্তনযোগ্য। সেই পরিবর্তন প্রশাসনের সদিচ্ছা ব্যতীত সাধিত হইবে না। সরকারের কর্তব্য, অবিলম্বে লিংডো কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর করা, ক্ষেত্রবিশেষে আরও কঠোর হওয়া। শিক্ষাঙ্গনে কোনও রাজনৈতিক দলই যাহাতে প্রবেশ করিতে না পারে, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। ক্ষুদ্র রাজনীতির যুক্তি প্রশ্ন তুলিবে, যে সিদ্ধান্তে দলের ছাত্রশাখাটি কার্যত উঠিয়া যাইবে, ক্ষমতাসীন দল সেই সিদ্ধান্ত করিবে কেন? ইহাই শাসক দলের পরীক্ষা। তাহারা সত্যই প্রশাসক হইতে পারিয়াছে, না কি দলমাত্র রহিয়া গিয়াছে, ছাত্র সংগঠন বিলুপ্তির কষ্টিপাথরেই তাহা যাচাই করা হইবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর পাঁচটি ক্ষেত্রের ন্যায় এই প্রশ্নেও পূর্বসূরি বামপন্থীদের অনুসরণ করিয়া দলতন্ত্রের ধ্বজা বহন করিবেন, না কি সত্যই পরিবর্তনের পথে হাঁটিয়া এই বৈপ্লবিক সংস্কারে হাত দিবেন, তাহাই দেখিবার। যদি তিনি ব্যতিক্রমী হইবার সাহস অর্জন করিতে পারেন, তাঁহার অন্যান্য জেদজনিত পাপের খানিক ক্ষালন হইবে।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাহারা তাণ্ডব করিল, প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে তাহারা বহিরাগত। ঘটনাটি প্রতীকী। ছাত্র রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলিও বহিরাগতই। তাহাদের সহিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংযোগ নাই, বিদ্যাচর্চার সংযোগ নাই। তাহারা শুধুমাত্র রাজনীতির ব্যাপারি। সেই রাজনীতির জন্য বৃহত্তর দুনিয়া মজুত রহিয়াছে। বিদ্যাঙ্গনে যদি ছাত্রদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আনিতেই হয়, তাহা প্রতিষ্ঠানের চরিত্রের সহিত সাযুজ্যহীন হইতে পারে না। সরকার লিংডো কমিশনের সুপারিশ, কঠোরতর চেহারায়, কার্যকর করুক। বিদ্যাঙ্গনের রাজনীতিতে যদি শুধুমাত্র প্রকৃত ছাত্রদেরই অধিকার থাকে, তবে তাহা রাজনৈতিক দলগুলির প্রভাবসীমার বাহির হইতে বাধ্য। যদি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে রসদ সরবরাহের আখড়া হিসাবে ব্যবহারই না করা যায়, তবে তাহাতে আর একটি প্রেসিডেন্সি-কাণ্ড ঘটিবার সম্ভাবনা বহুলাংশে কমিবে। অন্তত তেমনটি আশা করা চলে। |