অন্য নানা রাজ্য একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ করেনি। অথচ এই কাজটি
নিয়মিত না করলে রাজ্যের কোন জেলায় কতটা উন্নতি হচ্ছে, তার ভাল ছবি পাওয়া দুষ্কর।
বিবেক দেবরায় |
এর আগে আমি বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যে অর্থনৈতিক তারতম্য আছে, সে বিষয়ে লিখেছি। প্রত্যেকটি রাজ্যের ভিতরেও সচরাচর এক একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা এক এক রকম। যেমন, একই রাজ্যের এক জেলার সঙ্গে আর এক জেলার অনেক তফাত থাকতে পারে। এই তারতম্য বিচার করাও জরুরি। কিন্তু জেলা স্তরের তথ্য পরিসংখ্যান পাওয়া অনেক বেশি কঠিন। আমরা এই লেখায় অভ্যন্তরীণ বৈষম্যের একটি মাপকাঠিতে বিভিন্ন রাজ্যের আর্থিক অবস্থার মধ্যে একটা প্রাথমিক তুলনা করে দেখব।
২০০৩-০৪ সালে ১৪৭টি নির্ধারিত অনগ্রসর জেলার উন্নয়নের জন্য শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রীয় সম বিকাশ যোজনা। ২০০৬-০৭ সালে এই প্রকল্প অনগ্রসর অঞ্চল অনুদান নিধি (ব্যাকওয়ার্ড রিজনস গ্রান্ট ফান্ড বা বি জি আর এফ) নামে নতুন করে চালু হল, নির্দিষ্ট জেলার সংখ্যা বেড়ে হল ২৫০। অর্থাৎ, এটা জেলা-ভিত্তিক প্রকল্প। কী ভাবে এদের অনগ্রসরতা কমানো যায়? উত্তরটা চেনা। এদের জন্য দরকার আইনের শাসন, দরকার উন্নয়নের উপযোগী পরিকাঠামো এবং সামাজিক সম্পদ ও পরিবেশ। অনেক রাজ্যই এই অভাবগুলি পূরণ করতে বিশেষ সফল হয়নি। সেই কারণেই বি জি আর এফ মারফত কেন্দ্রীয় বরাদ্দের জন্য এত দাবি। কিছু রাজ্যকে দুই বা তার বেশি ভাগে ভাগ করার দাবিও কিছুটা এই অর্থ বেশি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই।
জেলা স্তরে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো মানব উন্নয়ন বিষয়ক যথেষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। জেলার মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অর্থাৎ, মোটামুটি ভাবে বললে, জেলার মাথাপিছু আয়ের তথ্য পাওয়া যায়। আমরা প্রত্যেকটি রাজ্যের দুটি করে জেলা নিয়েছি যে জেলার মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি এবং যেটির সবচেয়ে কম। তার পর দুইয়ের মাথাপিছু আয়ের অনুপাত কষেছি। অর্থাৎ, কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে এই অনুপাত যদি তিন হয়, তার মানে হল, সেই রাজ্যের সবচেয়ে সম্পন্ন জেলার মাথাপিছু আয় সবচেয়ে দরিদ্র জেলার মাথাপিছু আয়ের তিনগুণ। সাধারণত দরিদ্র জেলার (বা রাজ্যের) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনায় বেশি হয়। তাই মোট আয়ের তারতম্যের চেয়ে মাথাপিছু আয়ের তারতম্য আরও বেশি হয়ে থাকে। |
লক্ষণীয়, রাজ্যের সামগ্রিক অনগ্রসরতার সঙ্গে আন্তঃরাজ্য তারতম্যের কোনও স্পষ্ট সম্পর্ক দেখানো যায় না। এই তারতম্য বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশের মতো দরিদ্র রাজ্যে বেশি, আবার হরিয়ানার মতো তুলনায় সম্পন্ন রাজ্যেও বেশি। তথ্য নেওয়া হয়েছে যোজনা কমিশনের নথি থেকে। কোনও একটি নির্দিষ্ট বছরের তথ্য নয়, ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৮-০৯’এর মধ্যে বিভিন্ন বছরের।
তারতম্য কালক্রমে বাড়ছে না কমছে? যখন সামগ্রিক আয়বৃদ্ধির গতি বেশি হয়, তখন সাধারণত অসাম্য বাড়ে। ভারতেও তার লক্ষণ আছে। ১৯৯৯-২০০০-এর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, বিহার, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে সম্পন্ন জেলা এবং অনগ্রসর জেলার আর্থিক তারতম্য অনেকটা বেড়ে গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের ক্ষেত্রে তেমন বাড়েনি। ‘অনেকটা’ কথাটি আমি ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করেছি, কারণ পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, ঝাড়খণ্ড বা কেরলেও জেলা-ভিত্তিক বৈষম্য কিছুটা বেড়েছে।
মাথাপিছু আয় অবশ্যই বিচারের একমাত্র মাপকাঠি নয়। আদর্শ অবস্থায় দেখা উচিত মানব উন্নয়নের বিভিন্ন দিক, কারণ সেটাই তো আয়বৃদ্ধির আসল লক্ষ্য। রাজ্য স্তরে মানব উন্নয়নের যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ইউ এন ডি পি’র নির্দেশনায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে মানব উন্নয়ন সূচক (এইচ ডি আই) তৈরি হওয়ার পরে ক্রমে ক্রমে ভারতেও বিভিন্ন অঞ্চল এবং রাজ্যের অভ্যন্তরীণ মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি হচ্ছে। ২০০৪ এবং ২০০৫ সালে অনেকগুলি রাজ্য মানব উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশ করে, কয়েকটি রাজ্য তার পরেও একাধিক বার এই রিপোর্ট তৈরি করেছে। এই রিপোর্টগুলি থেকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের জেলাওয়ারি উন্নয়নের তুলনা করা যায়।
মুশকিল হল, পশ্চিমবঙ্গে সেই ২০০৪ সালে একটা রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল। সেই প্রথম, সেই শেষ। প্রায় এক দশক আগের সেই রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের মানব উন্নয়ন সূচক ছিল ০.৬১। তবে এটা হল রাজ্যের গড় হিসেব। জেলায় জেলায় বিরাট তারতম্য ছিল কলকাতার সূচক ছিল ০.৭৮, মালদহের ০.৪৪, মুর্শিদাবাদ: ০.৪৬, বীরভূম: ০.৪৭, পুরুলিয়া: ০.৪৫। অন্য নানা রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেরও উচিত নতুন মানব উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশ করা। তবে নীতি রচনার দিক থেকে আরও বেশি জরুরি হল উত্তরের (দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ) ও পশ্চিমের (পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম) জেলাগুলিতে এবং সুন্দরবন অঞ্চলে কী করণীয়, সেটা নির্ধারণ করা। সারা রাজ্যের গড় হিসেব দেখলে অনেক কিছুই বোঝা যাবে না।
|
সবচেয়ে সম্পন্ন জেলা ও সবচেয়ে অনগ্রসর জেলার মাথাপিছু আয়ের অনুপাত |
হরিয়ানা |
৯.৮৭ |
তামিলনাড়ু |
৩.৩০ |
উত্তরপ্রদেশ |
৯.২০ |
পশ্চিমবঙ্গ |
৩.২৭ |
বিহার |
৮.৬৫ |
হিমাচল প্রদেশ |
৩.১০ |
ছত্তীসগঢ় |
৫.২০ |
ঝাড়খণ্ড |
২.৮৩ |
ওড়িশা |
৪.৫৫ |
উত্তরাখণ্ড |
২.২৭ |
কর্নাটক |
৪.৪২ |
অন্ধ্রপ্রদেশ |
২.২৩ |
মধ্যপ্রদেশ |
৩.৯২ |
কেরল |
২.২৩ |
অসম |
৩.৬৬ |
রাজস্থান |
২.২২ |
মহারাষ্ট্র |
৩.৪১ |
পঞ্জাব |
১.৫৯ |
|
দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ |