শাশ্বতী ঘোষ লিখেছেন, “অবশ্য গত নভেম্বরে প্রণীত যৌননিগ্রহ থেকে শিশুদের সুরক্ষা আইনে এই সম্মতির বয়স ষোলো থেকে আঠারো বছর করা হয়েছে’’। (‘বয়স কত হলে তবে...’, ১৯-৩) আমি যত দূর জানি, ২০১২ সালের মার্চ মাসে সংসদে ওই আইনটি বিধিবদ্ধ হয়েছে। তার পরের মাসেই উত্তরপ্রদেশে ১৮ বছরের নীচে এক কিশোরী এক যুবকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে মন্দিরে বিয়ে করেছিল। তাঁর বাড়ির লোকজন ওই আইনের সাহায্য নিয়েই যুবকটির বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা রুজু করেছিলেন। গত বছর মে মাসে দিল্লি হাইকোর্ট যৌননিগ্রহ থেকে শিশুদের সুরক্ষা আইন ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে আখ্যায়িত করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল: আইনরক্ষক কিশোর-কিশোরীদের হেনস্থা করতে ওই আইনের অপব্যবহার করতে পারে।
প্রসঙ্গত, পুলিশ-প্রশাসনের ইচ্ছাকৃত অপদাথর্র্তা, আইনি জটিলতা ও বিলম্বিত বিচারব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের দেশে শিশুপুত্র-শিশুকন্যা এবং কিশোর-কিশোরীদের কাছে দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচারের চরম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এঁদের উপর যৌন হেনস্থা রোধে এবং এঁদের প্রতি অচিন্তনীয় অন্যায় ও অবিচারের প্রতিকারে তথা এঁদের অধিকার রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট বিধি প্রণীত হয়েছে। ওই বিধির বলে সাবালক-সাবালিকাদের সঙ্গে বালক-বালিকাদের একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা চলবে না। প্রতিটি শিশু ও কিশোর জীবন যথেষ্ট মূল্যবান মনে করে কেন্দ্র-রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন ও আইনি ব্যবস্থাকে এদের প্রয়োজন ও অধিকার সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং অধিকতর সচেতন থাকতেই হবে। সেই সঙ্গে আদালতে বারংবার সাক্ষ্য দিতে তলব করা চলবে না শিশুদের। তা ছাড়াও অভিযোগের এক বছরের মধ্যেই বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। |
এর আগে তিন বছরের ধর্ষিতা শিশুকন্যাকেও সাত-আট বছর বয়স অবধি সাক্ষ্যদানে বাধ্য করায় তা বিচারের নামে অনর্থক নিষ্ঠুরতা তথা প্রহসন অনুষ্ঠিত হত। স্মর্তব্য, শিশুদের প্রতি অবিচারের প্রতিকারেও তাদের অধিকার রক্ষার জন্য গত বছরের জুলাই মাসে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের অধিকার খর্ব করে একটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু আট মাস বাদেও কাজের কাজ এক কদমও এগোয়নি। স্বভাবতই কেন্দ্রের এই সংক্রান্ত বিধিটি সারা দেশে নির্যাতিত শিশু ও কিশোরদের আইনি ও মানবিক সহায়তা দানে এবং পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করতে যে অত্যন্ত উপযোগী হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এই আইন প্রবর্তনের আগে ভারতীয় ফৌজদারি বিধিতে ১৬ বছর বয়সকে সম্মতিদানের যোগ্য বয়স বলে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু সহমতের ভিত্তিতে সহবাসের বয়স ১৬ থেকে ১৮ করায় আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কমবয়সিদের ক্ষেত্রে যৌন সম্পর্কে শিশু, বালিকা অথবা কিশোরীর সম্মতি ছিল কি না, সেটা আদৌ ধর্তব্যের মধ্যে পড়বে না। সহজ কথায়, আইনি গ্রাহ্য হবে না। এর ফলে, ওই আইন চালুর পরে ১৮ বছরের কমবয়সি যে অগণিত বালিকা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এক ধরনের জটিলতা উদ্ভব হয়েছে। কারণ, সহবাসের ক্ষেত্রে বালিকা কিংবা তাঁর অভিভাবকের সম্মতি প্রদানের কোনও দামই যদি আইনের চোখে গ্রাহ্য না-হয়, তা হলে ওই পরিণয় শুধু অসিদ্ধই নয় উপরন্তু বলাৎকারের দায়ে সাত বছরের জেলের ঘানি টানতে হতে পারে তথাকথিত বিবাহিত স্বামীকে। এমনকী, বিবাহিত স্ত্রীকেও বাবা-মায়ের হেফাজতে গচ্ছিত না-রেখে যে কোনও নির্যাতিতা বালিকার মতো সরকারি হোমে রেখে দেওয়া হলে একটুও অবাক হব না।
অতএব অসঙ্গতি অবিচল থাকা সত্ত্বেও ওই আইনকে স্বেচ্ছায় সকলেরই মেনে নেওয়া উচিত। যেহেতু বালিকা বিবাহ আইনের চোখে সর্বদাই অপরাধ বলে গণ্য এবং অবৈধ ওই বিবাহের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের কোনও দায় সমাজের নেই। একই সঙ্গে আইনটির মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ জুড়ে ব্যাপক প্রচার হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এতে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কাছ থেকে পলায়নেচ্ছু প্রেমিক-প্রেমিকারা সকলে সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন যে, তাঁরা দোষী এবং তাঁদের অপরাধ শাস্তিযোগ্য।
মানসকুমার রায়চৌধুরী। কলকাতা-২৬ |