প্রবন্ধ ১...
তৈরি করেছিলেন নতুন ঐকমত্য

নস্মৃতি বড়ই ক্ষণস্থায়ী। ৮ এপ্রিল মার্গারেট থ্যাচারের মৃত্যুর পরে ফেসবুক, টুইটার-এর দুনিয়ায় অনেকেই বেশ বিরক্তি প্রকাশ করলেন যে, সেই ১৯৯০ সালে দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট ছেড়ে যাওয়া এক জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে এত সময় এবং জায়গা খরচ করার কী আছে! হতে পারে, তিনি পর পর তিন বার নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, হতে পারে তিনি ব্রিটেনের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তার পর গত তেইশ বছরে তো রাজনীতিতে তাঁর তেমন কোনও ভূমিকাই ছিল না, এত বাড়াবাড়ি কীসের?
ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মতে যিনি ‘ব্রিটেনকে রক্ষা করেছিলেন’, সেই নেত্রীর অবদান কী এবং কতখানি, সেটা বোঝার জন্য ফিরে দেখা দরকার, থ্যাচার-পূর্ববর্তী ব্রিটেনের অবস্থা কেমন ছিল। ১৯৭৯ সালে অল্প ব্যবধানে জয়ী হয়ে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন, ব্রিটেনকে তখন ‘ইউরোপের রোগী’ বলে ঠাট্টা করা হত। মাত্র বত্রিশ বছর আগে যে দেশ ছিল প্রাচীন রোমের পরে দুনিয়ার বৃহত্তম সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, সে তখন চরম অধোগতির পথে। বস্তুত, সেই ‘অবনতির সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা’ কী করে করা যাবে, সেটাই তখন ব্রিটেনের চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যাঁরা বাইরে থেকে সেখানে যেতেন, তাঁদের চোখে হয়তো এই করুণ বাস্তব ঠিক ধরা পড়ত না। বাইরে তখনও পুরনো মহিমার অবশেষ, ব্রিটিশ উচ্চবর্গ অপরিসীম আত্মশ্লাঘায় ভরপুর, অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ বিদ্যাচর্চার ঐতিহ্যে মহীয়ান, যথাযথ এবং সুশৃঙ্খল আচরণের প্রতি ব্রিটিশ সমাজের অন্তর্নিহিত নিষ্ঠা অটুট অতিথিদের শ্রদ্ধায় নত হওয়ার যথেষ্ট কারণ তখনও ছিল। কিন্তু এই গুণাবলি দেশের গভীর সমস্যার মোকাবিলায় খুব একটা কাজে লাগেনি।
বাইরে মহিমময়, ভিতরে ভিতরে কিন্তু ব্রিটেন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। উদ্যোগ এবং অভিযানের যে মানসিকতার জোরে ব্রিটিশরা এক দিন অর্ধেক পৃথিবী দখল এবং শাসন করতে সফল হয়েছিলেন, যে হাল-না-ছাড়ার চারিত্রিক দৃঢ়তায় তাঁরা হিটলারের বিরুদ্ধে কার্যত একক প্রতিরোধ গড়তে পেরেছিলেন এবং অসীম কষ্ট সহ্য করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন, সেই জোরটাই হারিয়ে যাচ্ছিল। তার জায়গায় তৈরি হচ্ছিল এক পরমুখাপেক্ষী সমাজ। সেই সমাজ জীবনধারণের এমন একটা মানকে নিজের প্রাপ্য বলে মনে করে, যার সংস্থান করার সাধ্য দেশের অর্থনীতির ছিল না। চড়া কর, অচল প্রযুক্তি, জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়নবাজি, কাজ করার মানসিকতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে ব্রিটেন সে দিন আর প্রায় মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। কিন্তু তখনও সে মানতে রাজি নয় যে, তার অতীত যত গৌরবেরই হোক, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতার মানুষের পক্ষে এই মানসিকতা বোঝা খুব কঠিন নয়।
বিজয়িনী। মস্কো সফরে মার্গারেট থ্যাচার, মার্চ ১৯৮৭। ছবি: এ এফ পি
মার্গারেট থ্যাচারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এইখানে যে, তিনি একটি সংশয়ী নির্বাচকমণ্ডলীকে বোঝাতে পেরেছিলেন, ব্রিটেন সাধ্যের বাইরে জীবনযাপনের চেষ্টা করছে এবং সেই কারণেই খরচের লাগাম টানা দরকার। রাজনীতিকরা সচরাচর মানুষকে আরও সুখে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে এবং সরকারি টাকা যথেচ্ছ খরচ করতেই অভ্যস্ত, তাই মার্গারেট থ্যাচারের এই অবস্থানকে বৈপ্লবিক বললে অত্যুক্তি হয় না। তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, রোগীকে প্রথমে তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে, তবে তার ব্যাধির উপশম হতে পারে।
ব্রিটিশ সমাজের দীর্ঘ দিনের লালিত কিছু ধারণাকে থ্যাচার সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন। মান্ধাতার আমলের উচ্চাবচ সমাজের কাঠামো সচেতন ভাবে ভেঙে দিয়ে সেই সমাজকে অনেক বেশি প্রতিযোগিতায় সক্ষম করতে চেয়েছিলেন তিনি, যাতে সেখানে নীচের তলা থেকে মানুষের উপরে ওঠার পথ অনেক বেশি সুগম হয়। বামপন্থীরা যে ভাবে দারিদ্রকে সকলের মধ্যে ভাগ করে দিতে চান এবং তাকে মহিমান্বিত করেন, তিনি ছিলেন তার চরম বিরোধী। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘আমরা এমন সমাজ চাই না যা নিজেকে সম্পদশালী এবং সম্পত্তিহীন, দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হিসেবে দেখবে, আমি চাই এমন এক দেশ, যেখানে সবাই হবে সম্পদশালী।’ ট্রেড ইউনিয়ন যে সব বিশেষ সুবিধা ভোগ করে আসছিল, তিনি সেগুলির অবসান ঘটাতে তৎপর হয়েছিলেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল ব্রিটেনে কাজের মানসিকতা ফিরিয়ে আনা। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি সরকারি ভূমিকার চেয়ে অনেক বেশি জোর দিয়েছিলেন ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং স্বনির্ভরতার উপর। ‘রাষ্ট্রের এক্তিয়ারকে দূরে সরিয়ে দেওয়া’র প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিলেন।
বিপ্লবীরা যে সব সময়েই পেশি ফুলিয়ে ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে লাল পতাকা উড়িয়ে রণং দেহি হুঙ্কার দিতে দিতে অবতীর্ণ হন, তা নয়। সাধারণ পরিবারের মেয়ে মার্গারেট রবার্টস নিরন্তর সংগ্রাম করে নিজের উত্তরণের পথ কেটে নিয়েছিলেন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা, পার্লামেন্টের আসন, তার পর এক দিন কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব। সে পথে কাঁটা কম ছিল না। লোকে তাঁকে জাঁদরেল এবং পেটি-বুর্জোয়া বলে তাচ্ছিল্য করেছে, ইন্টেলেকচুয়ালরা বিদ্রুপ করেছেন।
শেষোক্ত বর্গের অন্তর্ভুক্ত কিছু প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতিবিদের আমাদের অমর্ত্য সেন সহ অভিযোগ ছিল, সরকারের দায়দায়িত্ব হ্রাস এবং ভর্তুকি ছাঁটাইয়ের ফল সমাজের পক্ষে খুব খারাপ হবে। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন, মার্গারেট থ্যাচার নিছক গোঁয়ার্তুমি করে এই নীতি বলবৎ করেন। তাঁদের ধারণা ভুল ছিল। থ্যাচার নিজের বিশ্বাস এবং ধারণার প্রতি যতটা নিষ্ঠা সহকারে নীতি রূপায়ণ করেছিলেন, খুব কম রাজনীতিকের আচরণে তা দেখা যায়। তাঁর কঠোর আর্থিক নীতি অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার ব্যাপার ছিল না, তিনি অনেক ভেবেচিন্তে এই নীতি অনুসরণ করেন।
থ্যাচার ব্রিটিশ সমাজকে বিস্তর কৃচ্ছ্রসাধনে বাধ্য করেছিলেন। ভর্তুকি প্রত্যাহার এবং শ্রম আইন সংস্কারের ফলে অনেক কলকারখানা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি, বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। কিন্তু তারই পাশাপাশি অনেক শিল্প নতুন করে প্রতিযোগিতার শক্তি সংগ্রহ করে এবং উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। লন্ডনের পুরনো, প্রতিযোগিতা-আড়াল-করা পরিবেশ বাতিল করে তার দরজা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। লন্ডন যে আজও লগ্নি পুঁজির দুনিয়ার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত, সেটা থ্যাচারের অবদান ‘ভদ্রলোকি ধনতন্ত্র’র অচলায়তনটি তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তিনি পুরনো ঐকমত্যের রাজনীতির অবসান ঘটিয়েছিলেন, কিন্তু তৈরি করেছিলেন নতুন এক ঐকমত্যের রাজনীতি।
মার্গারেট থ্যাচার ‘গ্রেট ব্রিটেন’-এর গুরুত্ব ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। পুরোপুরি পারেননি। না পারার একটা কারণ, সমাজের অবক্ষয়টা ছিল খুব গভীর, আর অন্য কারণ এই যে, মানসিকতার পরিবর্তনটা তিনি সম্পূর্ণ ঘটাতে পারেননি। সাম্রাজ্যের অবসান এবং স্বত্ব হাতে তুলে দেওয়ার নতুন ধারার পরিণামে ব্রিটিশরা তাদের দৃঢ়চিত্ত হারিয়ে রাষ্ট্রের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কঠোর পরিশ্রম, মিতব্যয় এবং নিরন্তর আত্মোন্নতির যে ভিক্টোরীয় মূল্যবোধগুলি থ্যাচার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, ব্রিটিশ সমাজ তাদের প্রবল শক্তিতে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল। মহত্ত্ব অর্জনের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকলে মানুষ তার সর্বশক্তি দিয়ে উন্নতির চেষ্টা করে, ব্রিটিশ সমাজ সেটা হারিয়ে ফেলেছিল, কারণ মানুষ জানত, যে কোনও সমস্যা রাষ্ট্র সামলে দেবে। স্বভাবতই, থ্যাচারের নীতিতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিলেন অভিবাসীরা এবং অল্পসংখ্যক শিল্পবাণিজ্য-উদ্যোগীরা, কারণ তাঁদের মধ্যে পুরনো ‘সাম্রাজ্য’র মানসিকতাটা ছিল। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ‘নেটিভ’দের কাছে থ্যাচার খুবই অ-ব্রিটিশ ছিলেন।
তুলনামূলক ইতিহাস সব সময়েই খুব গোলমেলে, তাতে অতিসরলীকরণের আশঙ্কা থেকেই যায়। তবু মানতেই হবে, থ্যাচার তাঁর সংস্কার চালু করতে গিয়ে পুরনো সামাজিক মানসিকতার কাছ থেকে যে ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং পশ্চিমবঙ্গে ছোটখাটো পরিবর্তনের চেষ্টা যে ধরনের বাধা পেয়েছে, তাদের মধ্যে একটা মিল আছে। লক্ষণীয়, নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে ব্যবসায়িক উদ্যোগ, দূরদর্শিতা এবং দক্ষতার গুণাবলির কথা বলার চেষ্টা করেছেন। তিনি এমন এক সমাজকে থ্যাচারসুলভ উপদেশ দিয়েছেন, যারা ইংরেজের স্বভাবের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলিকে না বুঝেই আত্মসাৎ করেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.