|
|
|
|
বদলের ডাক বৃথা, সিপিএম সেই সিপিএমে |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
গত বিধানসভা ভোটের ফল বেরোনোর ক’দিন আগে সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন বলেছিলেন, “এ বার যদি সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হয়, তা হলে আমাদের গঠনমূলক, দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হবে।” এমনকী, কিছু দিন আগে দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে বিমান বসু বলেছেন, নতুন সিপিএমের জন্ম দিতে হবে। সততার সঙ্গে দলকে শুদ্ধকরণের পথে নিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু আজ রাজধানীর বুকে যোজনা কমিশনের দফতরের সামনে দলের ছাত্র সংগঠন যে কাণ্ড ঘটাল, তাতে মনে হচ্ছে ধর্মের কাহিনিতে সিপিএমের বিশেষ উৎসাহ নেই। আলিমুদ্দিন রয়েছে আলিমুদ্দিনেই। ষাটের দশকের শেষ ভাগে যে জঙ্গি আন্দোলন বামপন্থীরা শুরু করেছিলেন, সেই পরম্পরা আজও চলেছে। সে দিন বাস-ট্রাম পুড়েছিল, অবরোধ-ঘেরাও-হিংসা কম হয়নি। ক্ষমতায় আসার পর জ্যোতি বসুর দীর্ঘ শাসনে জেলায় জেলায় দলতন্ত্র এক ধরনের হিংসার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বদল আনার চেষ্টা করেছিলেন। উন্নয়ন ও শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে মারমুখী ট্রেড ইউনিয়ন, জঙ্গি ছাত্র আন্দোলন স্তিমিত করার চেষ্টা করেছিলেন। বিরোধী দল হিসেবে তখন তৃণমূল ছিল আক্রমণাত্মক। বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, সিপিএমের পরিত্যক্ত পথে হাঁটছে তৃণমূল। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব নিয়ে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন সূর্যকান্ত মিশ্র। সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্বের বরং অভিযোগ, পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূল জেলায় জেলায় তাঁদের কর্মীদের উপর ব্যাপক সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এই অবস্থায় দিল্লির ঘটনা সিপিএম-কে আরও কোণঠাসা করে দিল।
অথচ যে ঘটনার সূত্র ধরে দিল্লিতে আজ প্রতিবাদ দেখাল এসএফআই, সেই সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যুই একটা ভুল আন্দোলনের ফল বলে অনেকের মত। কলেজে ছাত্র নির্বাচন বন্ধ রাখার প্রতিবাদে সে দিন কলকাতার রাস্তায় আইন অমান্যে নেমেছিল এসএফআই। শিক্ষা জগতের অনেকেরই মতে, পড়াশোনার মানোন্নয়ন বা ভাল পরিকাঠামোর দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তা না করে, যে ছাত্র নির্বাচনকে ঘিরে বারে বারে উত্তপ্ত হচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, তার দাবিতে আন্দোলনে নামা হল কেন!
আন্দোলনের ধরন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আইন অমান্যের মতো নেতিবাচক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা নিয়েই অনেকে সন্দিহান। তার উপর সে দিন গোড়া থেকেই এসএফআই নেতারা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছিলেন বলে অভিযোগ। যার জেরে পুলিশও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
আলিমুদ্দিন কিন্তু তাদের ছাত্র সংগঠনের সেই নেতিবাচক রাজনীতির বিরোধিতা করেনি। বরং সুদীপ্তর মৃত্যু নিয়ে কেন আরও জঙ্গি আন্দোলন করা হচ্ছে না, সেই বিতর্ক উঠেছিল দলে। ‘কম মাত্রার’ সেই জঙ্গি আন্দোলনের জেরেই অবশ্য নাভিশ্বাস উঠেছিল কলকাতাবাসীর। কাজের দিনে ব্যস্ত সময়ে পথ অবরোধের মাসুল গুনেছেন তাঁরা। কিছু এলাকায় তো বন্ধও হয়েছে। এই আন্দোলন যত ক্ষণ তাঁদের রাজনৈতিক সুফল দেবে বলে মনে করছিলেন, তত ক্ষণ মুখ বুজেই ছিলেন আলিমুদ্দিনের কর্তারা। আজ পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে তাঁরা সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বলেই অনেকের মত।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছেন, “দিল্লিতে যে ঘটনা ঘটেছে, তার তীব্র নিন্দা করছি। এটা ভুল রাজনীতি। কেউ একে সমর্থন করবেন না।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও বলেন, “দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই ঘটনার নিন্দা করছি।” প্রকাশ্যে কিছু না বললেও একান্ত আলোচনায়ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরিও।
কিন্তু দিল্লির প্রতিবাদের পুরোভাগে যিনি ছিলেন, এসএফআইয়ের সেই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় কিন্তু বিন্দুমাত্র অনুতাপের সুর নেই। তাঁর কথায়, “এটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এর আগে বেঙ্গালুরুতে হয়েছে। এখন দিল্লিতে হল। সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যুর প্রতিবাদে আগামী দিনে মমতা যেখানে যাবেন, সেখানেই বিক্ষোভ দেখানো হবে।”
এসএফআই নেতাদের এহেন মনোভাবে আলিমুদ্দিনের কর্তারা ক্ষুব্ধ বলেই শোনা যাচ্ছে। বুদ্ধবাবু ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, “এ সব কী ছেলেমানুষি হচ্ছে! অবিলম্বে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।” প্রকাশ্যে কিন্তু এসএফআই নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আলিমুদ্দিন বলেনি। বরং গঠনতান্ত্রিক যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, ওটা পৃথক সংগঠন। শাস্তির প্রসঙ্গে বিমানবাবু কোনও মন্তব্য করেননি। সূর্যবাবু ঘটনার নিন্দা করার পরে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “নিন্দা যখন করছি, তখন তার মানে এই দাঁড়ায় যে, খোঁজ নিয়ে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেওয়া হবে। এসএফআই কী করবে, তা বলতে পারব না।”
জঙ্গি আন্দোলন বামপন্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কি না, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টেরি ইগলটন তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘হোয়াই মার্ক্স ওয়াজ রাইট’ বইতে দেখিয়েছেন, আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনে সে অর্থে বিপ্লব না-হলেও প্রচুর মৃত্যু ও দমনপীড়নের ঘটনা ঘটেছিল। আবার আইজাক ডয়েশ্যের লিখেছেন, ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলনে হিংসা হয়েছিল তুলনায় কম। মস্কোর প্রকৃত ক্ষমতা দখল হয়েছিল হিংসা ছাড়াই।
পরে স্তালিনীয় রণকৌশলে হিংসাকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই পথ পরিত্যাগ করে নতুন দলীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিতে।
নতুন পথে চলার কথা বলছে সিপিএম-ও। কিন্তু জঙ্গি আন্দোলনের শিকড় যে আলিমুদ্দিনের অনেক গভীরে! “ক্ষমতা হারিয়েও সিপিএমের চরিত্রের কোনও পরিবর্তন হয়নি,” কটাক্ষ তৃণমূল সাংসদ সোমেন মিত্রের। |
|
|
|
|
|