ছোট আঙারিয়া মামলা
আদালতে ‘গণহত্যা’র বিবরণ দিলেন বক্তার
পাঁচ বছর পরে আবার আদালতে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলেন বক্তার মণ্ডল।
বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিলেন, ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি ছোট আঙারিয়া গ্রামে তাঁর চোখের সামনেই পাঁচ জনকে খুন করা হয়েছিল। জানালেন পাঁচ বছর আগে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময়ে তিনি ভয়ে এই কথা বলতে পারেননি। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বক্তার বলেন, “খুনের হুমকি দিয়ে আমাকে মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সত্যি বললে আমার স্ত্রী, সন্তানদের খুন করা হবে। ধর্মাবতার, তাই বাধ্য হয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আমি মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম।”
গড়বেতার ওই গ্রামে তৃণমূলের পাঁচ কর্মীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে সিপিএমের উপরে। ওই এলাকার দুই সিপিএম নেতা তপন ঘোষ ও সুকুর আলি-সহ অন্য অভিযুক্তরা আগের বার বক্তারদের দেওয়া সাক্ষ্যের ফলে বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু, গড়বেতা এলাকায় যে দাপট ২০১১ সাল পর্যন্ত তাঁদের ছিল, তা এখন আর নেই। বক্তারদের বক্তব্য, সেই কারণেই সাহস করে এ বার সাক্ষ্য দিতে এসেছেন তাঁরা। আজ, মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেওয়ার কথা বক্তারের স্ত্রী আয়েষা মণ্ডলের।
আদালতের পথে বক্তার। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
সেদিনের ‘গণহত্যা’র পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সোমবার মেদিনীপুর জেলা আদালতের পঞ্চম অতিরিক্ত দায়রা বিচারক ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্যের এজলাসে শুনিয়েছেন বক্তার। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে গড়বেতায় তৃণমূল ও বিজেপি-র প্রাধান্য ছিল। অনেকগুলি পঞ্চায়েতও ছিল তাদের দখলে। সিপিএম নেতারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। মাঝে-মাঝে গ্রাম দখল করতে এলেও ব্যর্থ হন তাঁরা। তখন তপন, সুকুর, দীপক সরকার (জেলা সম্পাদক), সুশান্ত ঘোষ (প্রাক্তন মন্ত্রী) জনযুদ্ধের (এখন মাওবাদী) সাহায্যে বন্দুক নিয়ে এলাকা দখল করে। তৃণমূল কর্মীরা গড়বেতা শহরে পার্টি অফিসে আশ্রয় নেন।
বক্তারের কথায়, “দীপক সরকার ও সুশান্ত ঘোষের নির্দেশে তপন-সুকুর, দিবাকর ভুঁইয়া, প্রশান্ত পালেরা প্রায়ই আমাদের সঙ্গে দেখা করতেন। বলতেন, ওদের ঝান্ডা নিয়ে ঘুরলে কেউ কিছু বলবে না। ওই আশ্বাসেই ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি দুপুর দেড়টা নাগাদ গড়বেতা থেকে হাঁটতে হাঁটতে ১৫ জন তিন ভাগে ভাগ হয়ে সন্ধে সাড়ে ৬টা-৭টা নাগাদ আমার বাড়িতে পৌঁছই। স্ত্রীকে চা বানাতে বলে পাশেই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। মা বলেন, সিপিএম-কে বলে এসেছিস? না হলে তোদের মেরে ফেলবে। মাকে আশ্বস্ত করে বাড়ি ফিরে আসি।” তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। আচমকাই বাইরে বহু মানুষের চিৎকার শুনতে পান বক্তার। সঙ্গে প্রচুর টর্চের আলো। কী হয়েছে দেখার জন্য বাড়ি থেকে বেরোতেই স্থানীয় বাসিন্দা নিয়ামৎ আলির সঙ্গে দেখা হয়।
আদালতে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে অনর্গল সে দিনের কথা বলেন বক্তার, যেন দিন কয়েক আগের ঘটনা। রবিবার ফোনে আনন্দবাজার-কে অবশ্য তিনি বলেছিলেন, প্রতিটি মূহূর্তের কথা তাঁর ছবির মতো মনে রয়েছে।
বক্তার বলে চলেন, “নিয়ামৎ বলে তোরা পালা, তোদের মারতে আসছে। পালাব কী? দেখি, সিপিএমের লোকজন বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। আমি তখন পাশের বাঁশ ঝোপে লুকিয়ে পড়ি। বাঁশ ঝোপ থেকেই দেখছি, গোলাপ বলছে, ওদের পুড়িয়ে মেরে ফেল। প্রশান্ত বলছে, পেট্রোল দিয়ে আগুন লাগিয়ে দে। কেউ বেরোতে পারবে না। আমারই বাড়ির উনুন থেকে আগুন নিয়ে বাড়ির ৩-৪ জায়গায় আগুন লাগিয়ে দিল। আগুনের তাপে মোক্তার নেমে আসছিল। প্রশান্ত পাল তলোয়ার দিয়ে তার গলা কেটে দিল। বাড়ি লক্ষ করে গুলিও করে। আগুন থেকে বাঁচতে জানলা দিয়ে কেউ লাফ দিলেই তাকে লক্ষ করে ৩-৪ জন এক সঙ্গে গুলি চালাতে শুরু করছিল।” তপন ঘোষ, সুকুর আলি, দিবাকর ভুঁইয়া, গোলাপ, ভোলা, দিল মহম্মদ, সিরাজুল, সালেমৎ-সহ বেশ কিছু সিপিএম নেতা এই হত্যা চালিয়েছিলেন বলে বক্তার আদালতে জানিয়েছেন।
ওই ১৫ জনের সঙ্গে বাড়িতে তাঁর ৭ ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী-ও ছিলেন। তাঁরা কী করে বাঁচলেন?
বক্তারের দাবি, “আমার বাড়ির ঠিক পেছনেই শ্বশুরবাড়ি। ওরা গিয়ে সেখানে ঢুকে পড়ে। আমার ছোট মেয়ে নিলোফার যাওয়ার সময় মোক্তারের কাটা মুণ্ডুতে পা লেগে পড়ে যায়। সেই রক্ত লাগা জামা-সহ তাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলাম। পুলিশ জামাটা নিয়ে রেখেছিল।”
ঘটনার পর দিন গড়বেতা থানায় ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন বক্তার। মামলার শুনানি চলাকালীন ২০০৭-এর ১০ নভেম্বর এগরাতে ধরা পড়েন এই ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত তপন ও সুকুর। প্রশান্ত পাল, দিল মহম্মদ, ভোলা ওরফে মোক্তার শেখ, আজিজুল মিদ্যা ও আব্দুল খানরা তখনও পলাতক ছিলেন। সেই সময় সাক্ষীরা বিরূপ হতে থাকায় তপন-সুকুর ছাড়া ধৃত আরও ছ’জন বেকসুর খালাস পেয়ে যান।মেদিনীপুর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তপন-সুকুরকে দলের জেলা কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। এমনকী ‘দলের সম্পদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন তাঁদের।
ছোট আঙারিয়া মামলা কার্যত ঠান্ডা ঘরে চলে যায় সেই সময়। হতাশ সিবিআই কর্তারা মনে করেছিলেন, আর কোনও দিনই গড়বেতা-কাণ্ডের প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু, দিল মহম্মদের গ্রেফতার ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ২০১১ সালের ১৫ মে গড়বেতা থানার পুলিশ অস্ত্র আইনে দিলকে গ্রেফতার করে। তা জানতে পেরেই, ছোট আঙারিয়া কাণ্ডে অভিযুক্ত দিলকে সামনে রেখে সিবিআই নতুন করে তদন্ত শুরু করে। আদালতে নতুন করে শুনানির জন্য আবেদন করে সিবিআই।
এ দিন আদালতে আনা হয়েছিল দিল মহম্মদকে। শুনানি চলাকালীন আগাগোড়া মাথা নিচু করে বসেছিলেন তিনি। বক্তার সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন যখন, তখনও মাথা নিচুই ছিল। বক্তারকে সিবিআইয়ের আইনজীবী তাপসবাবু প্রশ্ন করেন, “আপনি যে বারবার দিল মহম্মদের কথা বলছেন, তাঁকে চেনেন?”
জবাবে বক্তার দিলের দিকে তাকিয়ে বলেন, “হ্যা, তিনি তো আদালতেই আছেন।” শুনানি শেষে বিচারক দিল মহম্মদের কাছে জানতে চান, তিনি সুস্থ কি না। জবাবে দিল বলেন, “আমি অসুস্থ। চিকিৎসা ঠিক মতো হচ্ছে না।” বিচারক তাঁকে চিকিৎসার আশ্বাস দিয়ে চলে যান।
আদালতে বিরোধীপক্ষের আইনজীবী বিশ্বনাথ ঘোষ দু’টি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। এক, এখন অনেক নতুন নাম উঠে আসছে, যাদের বিষয়ে আদালত ওয়াকিবহাল নয়। যেমন নিলোফার। আগে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। দুই, আগের বার বক্তার যা সাক্ষ্য দিয়েছেন তা নিয়ে নিয়ম বহির্ভূত প্রশ্ন করা হচ্ছে। সিবিআইয়ের পাশাপাশি তৃণমূল নেতা প্রদ্যোৎ ঘোষ-সহ একাধিক আইনজীবী এ দিন বক্তারের পক্ষে দাঁড়ান। বক্তারের সাক্ষ্যের সময় দু’পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বারবার তীব্র বাদানুবাদ হয়েছে এজলাসের মধ্যে। যা থামাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে বিচারককে।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.