|
|
|
|
বিরূপ বক্তারের নতুন সাক্ষ্য আজ |
ছোট আঙারিয়া মামলার পুনরুজ্জীবন |
সুনন্দ ঘোষ • কলকাতা |
প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে চলে যেতে যেতে সে আবার মাথা তুলতে চলেছে। চার-চার বছর চাপা পড়ে থাকার পরে আজ, সোমবার জীবন ফিরে পাচ্ছে একদা রাজ্য-রাজনীতিতে সাড়া জাগানো ছোট আঙারিয়া মামলা।
২০০১-এর ৪ জানুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায় ছোট আঙারিয়া গ্রামের বাসিন্দা বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে। অভিযোগ, ওই হামলায় গুলিও চালানো হয়, যাতে পাঁচ গ্রামবাসী মারা যান। তাঁরা সকলেই ছিলেন তৃণমূল সমর্থক। আঙুল ওঠে তদানীন্তন শাসক সিপিএমের দিকে। কিন্তু সিবিআইয়ের দাবি অনুযায়ী, মূল সাক্ষী বক্তার-সহ অন্যেরা আদালতে ‘উল্টো’ সাক্ষ্য দেওয়ায় ২০০৯ সালে মামলা কার্যত ঠান্ডা ঘরে চলে যায়। বেকসুর খালাস হয়ে যান তপন ঘোষ, সুকুর আলি সহ অভিযুক্ত আট সিপিএম নেতা। অভিযুক্তদের পাঁচ জন অবশ্য তখনও ফেরার।
এবং আজ মেদিনীপুর আদালতে ফের সেই মামলার শুনানি শুরু হচ্ছে। বক্তার আজই সাক্ষ্য দেবেন। কাল, মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেওয়ার কথা বক্তারের স্ত্রী আয়েষা মণ্ডলের। সিবিআই-গোয়েন্দাদের দাবি: বিরূপ হয়ে যাওয়া সাক্ষীরা এ বার ‘আতঙ্ক’ কাটিয়ে সত্যি কথা বলার সাহস পাচ্ছেন। ফলে এই দফায় মামলার এসপার-ওসপার হওয়ার যথেষ্ট আশা। এখন যে তিনি মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন না, আকারে-ইঙ্গিতে বক্তারও রবিবার তা আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন। |
|
কী ভাবে মামলা জিইয়ে উঠল?
সিবিআই-সূত্রের খবর: ২০১১-র মে মাসে গড়বেতায় অস্ত্র-আইনে দিল মহম্মদ নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ পাকড়াও করে। ছোট আঙারিয়া মামলায় ফেরার পাঁচ অভিযুক্তের তালিকাতেও তার নাম ছিল। সেই সূত্রে পরের মাসে সিবিআই তাকে হেফাজতে নেয়। তাকে জেরা করে পাওয়া নতুন কিছু তথ্যের ভিত্তিতে গড়বেতায় ক্যাম্প করে নতুন ভাবে ছোট আঙারিয়ার তদন্তে নামে সিবিআই। সস্ত্রীক বক্তার-সহ কিছু গ্রামবাসীর সাক্ষ্য নেওয়া হয় নতুন করে। তার পরে সিবিআইয়ের আইনজীবী তাপস বসু ছোট আঙারিয়া মামলার শুনানি ফের শুরু করতে মেদিনীপুর আদালতে আবেদন করেন। আর্জি মঞ্জুর হয়। স্থির হয়, পুরনো চার্জশিটের ভিত্তিতেই শুনানি হবে।
বহু বার আবেদন করা সত্ত্বেও ছোট আঙারিয়া মামলায় দিল মহম্মদ এখনও জামিন পায়নি। বস্তুত দিল মহম্মদের গ্রেফতারি আর বক্তার-সহ সাক্ষীদের পরিবর্তিত মনোভাবের জেরেই পরিস্থিতির মোড় ঘুরে গিয়েছে বলে সিবিআইয়ের দাবি। কী রকম?
সিবিআই-সূত্রটির বক্তব্য: যাঁরা এক সময় আদালতে বেঁকে বসেছিলেন, তাঁরাই এ বার এমন সব তথ্য দিয়েছেন, যাতে মামলাটির পুনরুজ্জীবনের সুযোগ এসেছে। শুধু তা-ই নয়, দিল মহম্মদকে সামনে রেখে বক্তার ও অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করায় ছোট আঙারিয়া-কাণ্ডে তপন ঘোষ-সুকুর আলির নামও ফের উঠে এসেছে। প্রসঙ্গত, মামলার গোড়া থেকে প্রধান অভিযুক্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের এই দুই সিপিএম নেতা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। আদালত তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে বলে। অবশেষে ২০০৭-এ, নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলাকালীন সেখান থেকে ফেরার পথে অস্ত্র-সহ দু’জন ধরা পড়ে যান পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায়। সিবিআই তাঁদের হেফাজতে নেয়। কিন্তু সাক্ষীরা বিরূপ হয়ে যাওয়ার সুবাদে ২০০৯-এর ২৮ মে তাঁরা ছোট আঙারিয়া মামলায় বেকসুর খালাস পেয়ে যান।
যদিও এই মুহূর্তে ওঁরা পশ্চিম মেদিনীপুরে নেই। সিবিআই-সূত্রে জানা যাচ্ছে, তপন আপাতত রয়েছেন বেঙ্গালুরুতে, সুকুর ত্রিপুরায়। তদন্তকারীদের ধারণা, এই দফায় বক্তারদের মতো সাক্ষীরা যদি উল্টো কথা না-বলেন, তা হলে তপন-সুকুরের নাম ঘটনাটিতে ফের জড়িয়ে পড়তে পারে। সাক্ষী হিসেবে বক্তার এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
সিবিআইয়ের দাবি: ২০০১-এর ৪ জানুয়ারির সন্ধ্যায় ছোট আঙারিয়া গ্রামের ওই ‘হত্যালীলা’ বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে আগাগোড়া দেখেছিলেন বক্তার। প্রসঙ্গত, ২০০৮ ও ২০০৯-এ মেদিনীপুর আদালতে এসে সে সম্পর্কেই সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছিলেন বক্তার ও তাঁর পরিবার। ঘটনায় নিহত হায়দার আলির স্ত্রী কাশ্মীরা বিবি ছিলেন অন্যতম প্রধান সাক্ষী। পরে ৩২ সাক্ষীর যে ১৬ জন বিরূপ হয়ে পড়েন, তাঁদের মধ্যে সস্ত্রীক বক্তার ও কাশ্মীরাও ছিলেন। ওঁরা বিরূপ হয়েছিলেন কেন?
সিবিআই-কর্তাদের ব্যাখ্যা: ২০০৯-এর ওই সময়ে রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। তখন তপন-সুকুরের মতো শাসকদলের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার ক্ষমতা বক্তারদের ছিল না। এখন জমানা পাল্টেছে, ওঁরা ভয় কাটিয়ে উঠেছেন বলে সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা মনে করছেন। ওঁরা আশাবাদী যে, সাক্ষীরা এ বার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ঘটনার ঠিকঠাক বিবরণ দিতে পারলে ছোট আঙারিয়া মামলায় একটা কিনারা হতে পারে। এবং এ দিন স্বয়ং বক্তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন, সাক্ষ্যের নয়া পর্বে তিনি সত্যি কথা বলতে পিছপা হবেন না। ছোট আঙারিয়া গ্রাম থেকে ফোনে তিনি বলেন, “তখন তো মুখ খুললেই প্রাণ যেত!
আতঙ্কের পরিবেশ ছিল। এখন তেমন পরিস্থিতি নেই।”
বক্তার আজও ছোট আঙারিয়া গ্রামের বাসিন্দা। থাকেন জ্বালিয়ে দেওয়া বাড়িটার একটু দূরে, অন্য বাড়িতে। কিন্তু ঘটনাটা তো ১২ বছর ৩ মাস ৪ দিনের পুরনো! খুঁটিনাটি স্মরণে আছে? বিয়াল্লিশ বছরের বক্তার জানাচ্ছেন, সে দিনের ঘটনার প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর মনে গাঁথা হয়ে রয়েছে। “বারো কেন, পঞ্চাশ বছর পরেও মনে থাকবে। আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে যে ভাবে মানুষগুলোকে খুন করা হল, তা কি ভোলা যায়?”
ছোট আঙারিয়া থেকে টেলিফোনে ভেসে আসে বক্তার মণ্ডলের কণ্ঠস্বর। |
পুরনো খবর: গড়বেতার গ্রামে ১৮ তৃণমূল সমর্থকের নৃশংস হত্যা |
|
|
|
|
|