ভারত সরকার অনাবাসী ভারতীয়দের একটি তালিকা বানাইতে চাহে। প্রস্তাবটি বিস্ময়কর। বিশ্বময় বহু দেশে এত লক্ষ ভারতীয়ের সুমারি তৈরি কি সত্যই সম্ভব? এবং জরুরি? বিশেষত ইহা যখন কোনও স্থায়ী সংখ্যা নহে? বহু নাগরিক ভিন্ন দেশে বাস করিবার সুবাদে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সহিত মিশিয়া গিয়াছেন। বহু ভারতীয় স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় নিজ সমাজের সংস্রববর্জিত। এমন কোনও নিয়ম নাই যে অন্য দেশে গিয়া বসবাসের সময়ে স্বদেশের কোনও না কোনও সূত্রের সহিত সংযোগ রাখিতেই হইবে, বহু লোকই তাহা রাখেন না। তবে কী ভাবে পরিচিত বা বিখ্যাত বা নথিভুক্ত নহেন, এমন লোকজনকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে? এগুলি সবই অবশ্য প্রায়োগিক সমস্যা। গভীরতর যৌক্তিক কিংবা তাত্ত্বিক সমস্যাও রহিয়াছে। কী কারণে অকস্মাৎ এই অনাবাসী গণনার প্রস্তাবনা? এই প্রয়াসের পশ্চাতের যুক্তিগুলি কি সত্যই সুযুক্তি?
প্রস্তাবনাটির পিছনে প্রধান চালিকাশক্তি, চিন। চিন নাকি অনাবাসী চিনাদের সকল খবর রাখে, এবং তাহাদের মাধ্যমে স্বদেশে লগ্নি আকর্ষণের চেষ্টা করে। ভারত সরকারও সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে চায়। মুশকিল হইল, ইহা কেবল আংশিক কাহিনি। পুরা কাহিনিটি হইল, চিন সকল মাধ্যমেই অনাবাসী চিনা কিংবা বিদেশি অ-চিনা সকলের নিকট হইতেই লগ্নিলাভের চেষ্টা করে। কিন্তু অনাবাসী তালিকা তৈরির অন্য মর্মার্থ যদি হয়, নিজ নাগরিকদের ‘দেখভাল’ করা, তবে স্মরণীয় যে, চিনের স্পষ্ট নীতি, অনাবাসীদের বিষয়ে মাথা না ঘামানো, এবং সেই সূত্রে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সহিত ঘাতপ্রতিঘাতে না যাওয়া। যস্মিন্ দেশে যদাচারঃ, খামোখা বিদেশনীতি কিংবা কূটনীতির সমীকরণে অনাবাসীদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত বিষয় জড়াইয়া ফেলা কেন? ভারতেরও ঠিক তাহাই করা উচিত। যে নাগরিকরা ভিন্ দেশে থাকিতে মনস্থ করিয়াছেন, তাহা তাঁহাদের সচেতন, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নির্বাচন। সকল নির্বাচনেরই দাম আছে। ভিন্ দেশের আচারবিচার অবস্থাব্যবস্থা মানিয়া লওয়াই সেই দাম। তালিকার প্রয়োজন নাই।
উল্লেখ্য, উপরের যুক্তি ব্যবহার করিয়াই কিন্তু ভারত সরকার তামিল প্রশ্নে শ্রীলঙ্কার সহিত সংঘর্ষে যাইতে চাহে না। তামিলনাড়ুর গোটা প্রাদেশিক রাজনীতি যখন আন্দোলিত ও নির্ধারিত হয় শ্রীলঙ্কার অনাবাসী তামিলদের ঘিরিয়া, কেন্দ্রীয় ইউ পি এ সরকার তখন এই যুক্তিতেই দিল্লির তামিল শরিকদের হারাইতেও পিছপা হয় না। আফজল গুরু কাশ্মীর-সন্তান হইলেও পারিবারিক ও আদর্শগত কারণে পাকিস্তান যখন তাঁহার উপর দাবি ছাড়িতে চায় না, তখন ভারত সে দাবি ভিত্তিহীন, অপ্রাসঙ্গিক বলিয়া উড়াইয়া দেয় এই যুক্তিতেই। সুতরাং এখন আবার যুক্তি পাল্টাইয়া অনাবাসী নাগরিক লইয়া অধিক নাচানাচি শুরু হইলে আশঙ্কা অন্যান্য ক্ষেত্রে ভারতের কূটনীতি অকারণে জটিলতর ও সমস্যাসঙ্কুল হইয়া পড়িবে। তাহার প্রয়োজন আছে কি? রাষ্ট্রনীতি তথা কূটনীতিতে সঙ্গতির মূল্য কিন্তু অপরিসীম। |