|
|
|
|
খোলস ছেড়ে মাতালেন মহিলামহল |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
মাটি, মা, মোদী।
এর আগে দেশের ঋণ শোধ করার কথা বলেছিলেন তিনি। আজ তাঁর মুখে মা-বোনদের ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ।
নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী মেয়েমহলে খুব জনপ্রিয়, এমনটা হলফ করে বলা মুশকিল। আজ কিন্তু চেনা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। যা দেখে তারিফ করছেন বণিকসভার অনুষ্ঠানে হাজির মহিলারা। কেউ কেউ তুলনা করেছেন রাহুল গাঁধীর সঙ্গে। কেউ কেউ আবার এগিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেসের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধির থেকে।
চার দিন আগে দিল্লিতেই এক বণিকসভার অনুষ্ঠানে নিজেকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন রাহুল। তাঁর সঙ্গে অঘোষিত যুদ্ধে নেমে পড়া মোদীকে তাই চেনা খোলস ছেড়ে বেরোতেই হোত। বিশেষ করে তাঁর বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ রয়েছে, শিল্পের ঢাক পেটালেও নিজের রাজ্যের গরিব-মহিলাদের বঞ্চিত করে রেখেছেন তিনি, তখন মহিলামহলের সামনে নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ থেকেই যায়। আজ তাই বণিকসভা ফিকি-র মহিলা শাখার উদ্যোগে বক্তৃতা-সভায় জাতি-ধর্ম-দলমত নির্বিশেষে মহিলাদের মন জয়ের চেষ্টা করলেন মোদী। মঞ্চের সামনে কর্পোরেট জগতের সঙ্গে জড়িত মহিলারা থাকলেও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী আসলে পৌঁছে যেতে চাইলেন দেশের নারী সমাজের কাছে। |
|
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ফিকির মহিলা শাখার কর্ত্রী কবিতা ভরদ্বাজ ও মালবিকা রায়। ছবি: পিটিআই |
অনেকেই বলছেন, ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন তিনি। রাহুলের দুর্গে প্রথম ঘা মেরেছিলেন দিল্লির শ্রীরাম কলেজে ছাত্র-যুবদের মন জয় করে। আর এ বারে নিজস্ব ছন্দে মন কাড়লেন মহিলাদের। নারীদের নাড়ি বুঝে তিনি প্রায় এক ঘণ্টার বক্তৃতাকে সরস মোড়ক দিলেন। যার ফল, মহিলারা তাঁকে ‘শক্তিশালী’ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরলেন।
সাধারণত মোদী বলতেই ঔদ্ধত্য ছবি ভেসে ওঠে, যিনি সব সময় গুজরাতের আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে বড়াই করেন। তিনিই মহিলাদের বলছেন, অন্য সাধারণ মানুষের মতো তাঁরও খামতি রয়েছে। ভগবান এমন উচ্চতা দেননি, যে নিজের খামতি ধরতে পারবেন। আর সেই খামতি শুধরে সঠিক দিশায় এগোতে ‘মা’দের থেকে আশীর্বাদও চেয়ে নেন মোদী। যেমন এর আগে ভুল স্বীকার করেছিলেন গুজরাত দাঙ্গার নাম না করে।
মহিলাদের শক্তি চিনে তাঁদের সঠিক পথে ব্যবহার কী ভাবে করা যায় ও গুজরাতে হাতে-কলমে কী ভাবে তিনি তা রূপায়ণ করেছেন, বিভিন্ন ছোট ছোট দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি মাতিয়ে দিলেন বক্তৃতা-সভাকে। আর জুড়লেন এমন সব মন্তব্য যাতে মেয়েদের কাছে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হয়। কখনও বললেন, “বেশি সংখ্যায় মা-বোনেরা আসবেন বলে শেষ মুহূর্তে অডিটোরিয়াম বদল করতে হয়েছে। জানি, তার জন্য অনেক কষ্ট হয়েছে আপনাদের।” কখনও আবার প্রশ্ন, “আপনাদের মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়ে যায়নি তো? পরের অনুষ্ঠান বিকেল চারটেয়। আমি তো অনর্গল বলে যেতে পারি। কিন্তু খিদে পেলে মা-বোনেরা না খেয়ে বসে থাকবেন, সেটাও তো হতে পারে না!”
গুজরাতে মহিলারা কী ভাবে স্বনির্ভর হয়েছেন, তার একাধিক উদাহরণও এসেছে মোদীর বক্তৃতায়। কখনও অশিক্ষিত আদিবাসী মহিলাদের তৈরি ‘লিজ্জত’ পাপড়ের ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা, কখনও দামী পোশাক তৈরির পিছনে গরিব মেয়েদের ঘাম ঝরানোর কথা, কখনও আবার আমদাবাদের জাসসু বেনের পিৎজার কাহিনি টুকরো টুকরো ছবিতে তৈরি করেছেন কোলাজ। আবার কেন্দ্রকে কটাক্ষ করে বলেছেন, রাজ্যে মহিলাদের সংরক্ষণ বিলটি গুজরাতের ‘মহিলা’ রাজ্যপাল আটকে রেখেছেন!
সব দেখেশুনে মহিলারা আজ আপ্লুত। ফিকি-র মহিলা শাখার চেয়ারপার্সন অবন্তী মুরারকা ঝুনঝুনওয়ালা বলেন, “মোদীর বক্তৃতা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।
যদি গ্রামের সাধারণ মহিলারা এ ভাবে নিজেদের উদ্যোগে স্বনির্ভর হতে পারেন, তা হলে শহুরে মহিলারা পারবেন না কেন? আমাদের ভিতরে শক্তিই আসলে চিনিয়ে দিয়েছেন মোদী।”
রাহুলের সঙ্গে তুলনা টেনে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর ইউএন রিলেশনসের ভাইস প্রেসিডেন্ট রতন কল বলেন, “রাহুলের তো কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। মোদী নিজে সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি যা যা বলেছেন, নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলেছেন। দেশের নেতৃত্ব তাঁরই করা উচিত।”
ফিকি-র মঞ্চ রাজনৈতিক ছিল না। তাই নিজের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এই সভার কয়েক ঘণ্টা পরে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে কেন্দ্রকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন মোদী। সেখানে বিষয় ছিল ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বোচ্চ প্রশাসন’। যা কি না আসলে মোদীরই মন্ত্র। মনমোহন সিংহ সরকারের নীতিহীনতা ও বিরোধী শাসিত রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার জন্য সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাই এখন প্রশ্নের মুখে। সেটিই বারবার বিভিন্ন দৃষ্টান্তে তুলে ধরেন তিনি। তবে অনেকেই বলছেন, প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও মোদীর যাবতীয় কর্মসূচি যে দিল্লির তখ্ত দখলের নকশা মেনেই হচ্ছে, সেটা তাঁর ধারাবাহিক কর্মসূচিতেই স্পষ্ট। সরাসরি না বললেও নিজে প্রধানমন্ত্রী হলে দেশ কী ভাবে চালাবেন, প্রশাসনিক কাঠামোয় কী বদল তিনি করতে চান, তার রূপরেখাও আজ বাতলে দিয়েছেন মোদী।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী যতই দেশের মন জয় করতে নামুন না কেন, বিরোধীরা কী করে ছেড়ে দেন তাঁকে? মোদী যতই মহিলাদের মন জয় করার চেষ্টা করুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা মায়াবতীর মতো মহিলা নেত্রীদের সমর্থন কি তিনি হাসিল করতে পারবেন সে প্রশ্ন এখনও একই ভাবে প্রাসঙ্গিক। কংগ্রেস নেতারা আজ বলছেন, “মোদী গুজরাতে মহিলাদের জন্য কিছুই করেননি। নিজের রাজ্যেই যেখানে কাজ অসম্পূর্ণ রেখেছেন, গোটা দেশে তিনি কী করবেন?” আর মোদীর এই খোলস ছাড়ার চেষ্টাকে কটাক্ষ করে সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, “চিতা নিজের ছাপ ছেড়ে যায়। মোদী যতই চেষ্টা করুন, ভারতের ইতিহাসে গুজরাত দাঙ্গার ছাপ কখনওই মিটবে না।”
|
মোদী-কথা |
• রুটি বানাতে গিয়ে আঙুলে ছেঁকা খেলে মহিলারা চেষ্টা করেন তা স্বামীর নজরে আনতে। স্বামী তেমন পাত্তা দেন না। সেই মহিলাই হয়তো সেল-এ শাড়ি কিনতে গিয়ে খবর পেলেন, বাড়িতে আগুন লেগেছে আর ছেলে রয়ে গিয়েছে ঘরে। তিনিই তখন সব ছেড়ে ছুটে আসবেন ছেলেকে বাঁচাতে। এখানেই লুকিয়ে নারীশক্তি।
• কে বলেন মহিলারা ব্যবসা করতে পারেন না? আমদাবাদে জাসসু বেনের পিৎজা যে কোনও বড় সংস্থাকে হার মানাত। এখন আমার এই কথা শুনে মিডিয়া খুঁজবে, ‘কলাবতী’র (রাহুল গাঁধী সংসদে যে কলাবতীর প্রসঙ্গ তুলেছিলেন) মতো কেউ নন তো জাসসু? জানিয়ে রাখি, পাঁচ বছর আগে জাসসু মারা গিয়েছেন। কিন্তু নিজের পিৎজা ব্যবসার প্রসার করে গিয়েছেন।
• কোনও পাঁচতারা হোটেলে গেলে দেখবেন মেনুতে স্যালাড, দই, পাপড় মিলিয়ে অনেক কিছু থাকে। কিন্তু পাপড়ে লেখা থাকবে ‘লিজ্জত পাপড়’। গুজরাতের আদিবাসী এলাকার অশিক্ষিত মহিলারা আশি টাকা দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন। এখন শুধুমাত্র মহিলাদের উদ্যোগেই কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে।
• গুজরাতের গির অরণ্যে সিংহ থাকে। সেখানে জঙ্গলের গাইড ও টুরিস্ট গাইড মহিলা। যখন আমি সেই সিদ্ধান্ত নিই, অফিসাররা বলছিলেন, এ কী করছেন? জঙ্গলে চলতে গেলেই পদে পদে সিংহ আসবে! কিন্তু দেখুন, এখন মহিলারা কী ভাবে কাজ করছেন।
• বাঘের সংখ্যা কমছে বলে কেন্দ্র ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। কিন্তু সিংহের সংখ্যা কি বাড়ছে? যোজনা কমিশনকে বারবার বলেছি, সিংহ সংরক্ষণে টাকা দিন। কমিশন ভারত সরকারকে চিঠিও লিখেছে। কিন্তু কিছু হয়নি। কেন? বাঘ কি ধর্মনিরপেক্ষ আর সিংহ কি সাম্প্রদায়িক?
• সরকার ও জনতার মধ্যে টানাপোড়েন কমানোর উপায় কী? রাজনৈতিক নেতাকে ‘না’ বলতে শিখতে হবে, আমলাদের ‘হ্যাঁ’ বলতে শিখতে হবে। নেতারা তো মিষ্টি মুখে ‘না’ হওয়ার বিষয়কেও ‘হ্যাঁ’ বলে দেবেন। কিন্তু পরে আমলারা নিয়ম দেখিয়ে তা আটকে দেবেন।
• আমি হিন্দুবাদী। মনে করি, চার ধাম ঘুরলেই মোক্ষলাভ হবে। কিন্তু প্রশাসনে এমন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে যে, ৩২ জায়গায় ফাইল না ঘুরলে মোক্ষলাভ হবে না। এটি কম করতে হবে। FILE-এর বর্ণমালা বদলে LIFE করতে হবে। সরকার যতই ফাইলে ব্যস্ত থাক, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় লাইফ অর্থাৎ জীবন জুড়তে হবে।
|
এই সংক্রান্ত খবর... |
• লগ্নির আগাম প্রস্তাব পকেটে নিয়েই এ রাজ্যে পা মোদীর |
|
|
|
|
|