‘আমি ঐকমত্যের রাজনীতি করি না, আমি নিজের বিশ্বাসের রাজনীতিতে আস্থা রাখি।’ ১৯৭৯ সালে, ব্রিটেনের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর বলেছিলেন মার্গারেট থ্যাচার। আজকের ভারতীয় রাজনীতিকরা যখন ঐকমত্যের আলেয়া-সন্ধানী, তখন থ্যাচারের এই উক্তির মাহাত্ম্য বোঝা সম্ভব। নিজের বিশ্বাসে অবিচলিত থাকতে পারার ক্ষমতাই মার্গারেট থ্যাচারকে উইনস্টন চার্চিল-পরবর্তী ব্রিটিশ রাজনীতিতে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আসনটির স্থায়ী অধিকার দিয়েছিল। তাঁর নিজের কনজার্ভেটিভ দল এবং বিরোধী লেবার পার্টি, ব্রিটিশ রাজনীতির উভয় মেরুই বদলে গিয়েছিল তাঁর এগারো বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের অভিঘাতে।
তৎকালীন সোভিয়েত মিডিয়া তাঁকে ‘দি আয়রন লেডি’ আখ্যা দিয়েছিল। ব্যঙ্গার্থে, অবশ্যই। থ্যাচার কিন্তু পছন্দ করেছিলেন উপমাটি। জঙ্গি সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়নের দাপট পাকাপাকি ভাবে শেষ করাই হোক অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ, লৌহমানবী রাজনীতির সমীকরণকে কখনও নিজের বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে স্থান দেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর তিন দশকে ব্রিটেন যে ভাবে সমাজতন্ত্রের পথে হেঁটেছে, তাতে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে তো বটেই, আন্তর্জাতিক মঞ্চে অর্ধেক দুনিয়ার একদা অধীশ্বর এই দ্বীপরাষ্ট্রটি তার প্রাপ্য গুরুত্বের বহুলাংশ হারিয়েছে। থ্যাচারের বিশ্বাস ছিল, ব্রিটেনকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে পারে বাজার। এবং, বাজার অর্থনীতি বীরভোগ্যা।
তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন মিলটন ফ্রিডম্যানের অনুগামী। টাকার জোগান কমিয়ে, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পথে হেঁটেছিলেন তিনি। সরকারি খরচে রাশ টেনেছিলেন কঠোর ভাবে। উচ্চশিক্ষায় এমনই ভর্তুকি কমিয়েছিলেন যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রথা মেনে সাম্মানিক ডক্টরেট দিতে চাইলে গভর্নিং অ্যাসেম্বলির ভোটে সেই প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। ডেভিড ক্যামেরন তাঁকে ‘গ্রেট’ বলবেনই তো! ব্রিটেনের কর কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন করেন তিনি করের নিশানা আয়ের বদলে ভোগব্যয়ের দিকে সরিয়ে আনেন। আর্থিক থ্যাচারিজম-এর সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল রাষ্ট্রীয় সংস্থার বিলগ্নিকরণ। বিদ্যুৎ, গ্যাস, জল থেকে ইস্পাত, সব সীমান্তই তিনি খুলে দিয়েছিলেন বেসরকারি পুঁজির জন্য।
জীবনধারার ছাপই হয়তো চেতনাকে গড়েছিল। মার্গারেট হিল্ডা রবার্টস-এর বাবা-মা লিঙ্কনশায়ারে মুদিখানা চালাতেন। ‘মুদির মেয়ে’ হওয়ার জন্য ব্রিটেনের উচ্চাবচ রাজনৈতিক সমাজে কম কথা শুনতে হয়নি তাঁকে। আবার হয়তো এই অতি সাধারণ শৈশব-যৌবনের কল্যাণেই তিনি আমজনতার নাড়ি বুঝতে পারতেন। তাঁর বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্তে ব্রিটেনের বহু সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার কিনতে পারলেন। তাঁরা হলেন দেশের অর্থনীতির ‘স্টেকহোল্ডার’। সরকারি বাড়ি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত অনেক মানুষকে এই প্রথম বার বাড়ির মালিকানার স্বাদ দিল।
আর যে সিদ্ধান্ত তাঁকে তুঙ্গ জনপ্রিয়তা দিয়েছিল, তা ফকল্যান্ড যুদ্ধ। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনা যখন দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি এই ব্রিটিশশাসিত ভূখণ্ড দখল করে, তখন প্রায় সকলেই একমত ছিলেন ওইটুকু একটা দ্বীপের জন্য ব্রিটেন যুদ্ধ করবে না। পারবেও না। থ্যাচার সবাইকে ভুল প্রমাণিত করে যুদ্ধজাহাজ পাঠালেন। যুদ্ধ জিতলেন। এবং, এই জয়কে জুড়ে দিলেন ব্রিটিশ জাত্যভিমানের সঙ্গে। জনপ্রিয়তার তুফান উঠবেই। মনে পড়বে ইন্দিরা গাঁধীর বাংলাদেশ যুদ্ধের কথা। যুদ্ধজয়ের জনপ্রিয়তায় ভর করে নির্বাচন জিতে দু’জনে অবশ্য দু’পথে হেঁটেছিলেন।
থ্যাচার বহুকীর্তিমতী। কিন্তু যদি একটিমাত্র কারণে ইতিহাস তাঁকে স্মরণে রাখতে চায়, তা অবশ্যই খনি শ্রমিকদের জঙ্গি আন্দোলনের সামনে বিন্দুমাত্র নতিস্বীকার না করা। ১৯৮৪ সালে ন্যাশনাল কোল বোর্ড ২০,০০০ কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত করেছিল। প্রতিবাদে শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘট ডাকল। তার আগেই থ্যাচার ইউনিয়নের আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন করেছিলেন। তার ফলে, এই ধর্মঘট বে-আইনি ঘোষিত হল। থ্যাচার ধর্মঘটীদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করলেন। ফকল্যান্ড যুদ্ধের তুলনা
টেনে বললেন, বাইরের শত্রুদের মোকাবিলা করেছি, ঘরের শত্রুদেরও করব।’ প্রায় এক বছর পর কোনও দাবি আদায় না করেই ইউনিয়ন ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে বাধ্য হল। ব্রিটেন থেকে জঙ্গি ইউনিয়নের চিরবিদায় ঘটল।
১৯৯০ সালে, ১১ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বের পর, দলীয় রাজনীতির দ্বন্দ্বে পদত্যাগ করলেন থ্যাচার। আরও দু’বছর এম পি ছিলেন তিনি। তার পর আর ব্রিটিশ রাজনীতির মূল স্রোতে তাঁকে দেখা যায়নি। তাঁর প্রভাব অবশ্য অনপনেয়। |