সোমবার ৮৭ বছর বয়সে মারা গেলেন ব্রিটেনের প্রাক্তন এবং একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এ দিন সকালে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন থ্যাচার পরিবারের মুখপাত্র লর্ড বেল।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে একটানা সাড়ে ১১ বছর কাটিয়েছেন থ্যাচার। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০। যে কোনও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিরিখে দীর্ঘতম। সেই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, “আমি এটা দেখে খুশি যে, এখানে আসার আগে ব্রিটেনের যে অবস্থা ছিল, তার থেকে অনেক অনেক ভাল অবস্থায় তাকে রেখে যাচ্ছি।” বস্তুত, ৭০-এর দশকের শেষ ভাগে ভেঙে পড়া অর্থনীতি আর জঙ্গি আন্দোলনে দীর্ণ শিল্পচিত্র কঠোর হাতে বদলে দেওয়াই থ্যাচারের সব চেয়ে বড় কৃতিত্ব। তাঁর হাত ধরে আক্ষরিক অর্থেই ‘পরিবর্তন’ এসেছিল ব্রিটেনে।
অথচ, প্রধানমন্ত্রী হবেন এমন প্রত্যয় ছিল না থ্যাচারের। ১৯৭৩ সালেই এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার জীবদ্দশায় বোধহয় কোনও মহিলা প্রধানমন্ত্রী হবেন না।” কিন্তু সুযোগ এলো আচম্বিতে। ১৯৭৫ সালে কনজারভেটিভ পার্টির অন্দরের ভোটাভুটিতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে হারিয়ে বিরোধী দলনেত্রী হলেন। আর তার চার বছর পরেই প্রধানমন্ত্রী। |
দেশে জিনিসপত্রের দাম তখন বেশ চড়া। বাজেট ঘাটতি বিপুল। অসন্তোষের জেরে টালমাটাল দশা শিল্প ক্ষেত্রের। কড়া হাতে হাল ধরলেন থ্যাচার। সরকারি খরচ কমিয়ে রাশ টানলেন মূল্যবৃদ্ধিতে। দরজা খুলে দিলেন বেসরকারি পুঁজির জন্য। রাষ্ট্রীয় সংস্থার বিলগ্নিকরণ করে ইতি টানলেন সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণায়। জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপারে দেখালেন অনমনীয় মনোভাব। খনি শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে অনড় রইলেন গোটা একটা বছর। শেষে পিছু হটতে হল শ্রমিক নেতাদের। লৌহ মানবীর হাতে পড়ে ধীরে ধীরে বদলাল ব্রিটেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের কথা মনে পড়তে পারে অনেকের। মনে হতে পারে ৩৪ বছর আগে ব্রিটেনে যে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েছিলেন মার্গারেট থ্যাচার, আজ এ রাজ্যেও সেই একই পরীক্ষার সম্মুখীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। থ্যাচারের মতোই যিনি উঠে এসেছেন মধ্যবিত্ত সংসার থেকে। (লিঙ্কনশায়ারে মুদির দোকান ছিল থ্যাচারের বাবার।) থ্যাচারের মতোই বহু প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে তাঁকে আসতে হয়েছে রাজনীতির সামনের সারিতে।
কোন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলেন মমতা? গত সাড়ে তিন দশকের বন্ধ্যা রাজনীতি, জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন রাজ্যকে সর্বনাশের কিনারায় এনে দিয়েছিল। বাম আমলের শেষ বেলায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগ খানিকটা আশার আলো জাগিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু শাপমুক্তি ঘটেনি। অনেক রাজনীতিকেরই মতে, থ্যাচারের মতো কঠোর প্রশাসক হয়ে ওঠার ইঙ্গিত অন্তত কিছু ক্ষেত্রে মমতা দিয়েছেন। যেমন, বন্ধ-হরতালের রাজনীতি বরদাস্ত না-করার প্রশ্নে। যদিও শেষ বিচারে রাজ্যকে উন্নয়নের সড়কে দাঁড় করাতে গেলে আরও বিস্তর পথ হাঁটতে হবে তাঁকে। ওই রাজনীতিকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে থ্যাচার কিন্তু বিন্দুমাত্র দ্বিধায় ভোগেননি। কী করতে হবে তা নিয়ে তাঁর মনে কোনও সংশয় ছিল না। থ্যাচারের নিজের কথাতেই, ‘দ্য লেডি ইজ নট ফর টার্নিং’। মমতা সম্পর্কে এখনও সে কথা বলা চলে না।
আজ থ্যাচারের মৃত্যুর পরে তাঁর আপসহীন রাজনীতি আর নেতৃত্ব ক্ষমতার উল্লেখ করে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মমতা লিখেছেন, “প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ওঁর সেই বিখ্যাত উক্তির কথা আমার মনে পড়ছে: যেখানে অনৈক্য আছে, সেখানে যেন আমরা সমন্বয় আনতে পারি। যেখানে ভ্রান্তি আছে সেখানে যেন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারি। যেখানে দ্বিধা আছে, সেখানে যেন বিশ্বাস আনতে পারি। যেখানে হতাশা, সেখানে যেন আশার সঞ্চার করতে পারি।” মমতার দলের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারেরও মতে, “অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। ওঁর রাষ্ট্র পরিচালনা দৃষ্টান্তমূলক।” আর মমতার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির মন্তব্য, “ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা শীর্ষে পৌঁছতে তাঁকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়েছিল। পেরোতে হয়েছিল হাজার প্রতিবন্ধকতা। সেই জন্যই তিনি আয়রন লেডি।”
যে একরোখা রাজনীতির জন্য মমতার দেশ জোড়া পরিচিতি, থ্যাচারকে তার পথপ্রদর্শকই বলা চলে। ঐকমত্যের দর্শনে তাঁর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। বলতেন, “একমত হওয়া মানে আসলে সমস্ত বিশ্বাস, নীতি, মূল্যবোধ, নিয়ম বাদ দিয়ে এমন একটা বিশ্বাসে পৌঁছনো, যাতে কেউই বিশ্বাস রাখেন না এবং যার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদও জানান না।”
সমাজতন্ত্রে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তাই খোলাখুলিই বলতেন, সমাজতন্ত্র ‘আর্থিক দুরবস্থার’ জনপ্রিয় কারণ। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাশে পেয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগনকে। তাঁদের ইন্ধনেই ভেঙে পড়েছিল বার্লিন প্রাচীর। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমাজতন্ত্রের নিগড় থেকে মুক্ত করার চেষ্টা শুরু করেছিলেন যিনি, সেই মিখাইল গরবাচভ সম্পর্কে থ্যাচারের মন্তব্য ছিল, ‘ওঁর সঙ্গে কাজ করা চলে’। তাই ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ২৩ বছর পরেও বোধহয় তাঁকে ‘ক্ষমা’ করতে পারেনি এ দেশের বামপন্থীরা। মৃত্যুর দিনেও থ্যাচারকে উপেক্ষা করে সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাটের বক্তব্য, “ওঁর সম্পর্কে আমি কোনও মন্তব্য করব না।”
সমালোচনা অবশ্য দেশেও বিস্তর কুড়িয়েছেন থ্যাচার। তাঁর আর্থিক সংস্কারের বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, দেশকে সমৃদ্ধ দক্ষিণ আর গরিব উত্তর এই দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন থ্যাচার। তাঁর আমলেই ব্রিটেনে বেকারের সংখ্যা ছুঁয়েছিল ৩০ লক্ষ। তিরিশের দশকের সেই আর্থিক সঙ্কটের পর সব চেয়ে বেশি।
ফলে সাফল্য সত্ত্বেও জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন থ্যাচার। ১৯৮১ সালেই তাঁকে দেশের সর্বকালের সব চেয়ে অপছন্দের প্রধানমন্ত্রী তকমা দিয়েছিল এক জনমত সমীক্ষা। কিন্তু সেই হাওয়া থ্যাচার বদলে দিলেন ফকল্যান্ড যুদ্ধের জোরে। দেশপ্রেমের জোয়ারে ’৮৩ সালে ফের জিতলেন। ১৯৮৭ সালে আবার ক্ষমতায় এলেন আরও বড় ব্যবধানে।
আর তার পর একরোখা থ্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হল তাঁর নিজের দলেই। থ্যাচারের বসানো একটা করের বিরুদ্ধে তখন উত্তাল বিক্ষোভ। দাঙ্গা পরিস্থিতি। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনাস্থা আনলেন দলের বিরোধীরা। থ্যাচার বললেন, “আমি লড়াই চালিয়ে যাব। জেতার জন্যই লড়বো।” কিন্তু তার পরেই কোথায় যেন হারিয়ে ফেললেন সেই লৌহ মানবী সত্তা। পরের দিনই পদত্যাগ করলেন। ১৯৯০-এর ২৮ নভেম্বর শেষ হল থ্যাচার যুগ।
তার পরেও দু’বছর অবশ্য ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। কিন্তু ক্রমশই গুটিয়ে নিচ্ছিলেন নিজেকে। ২০০২ সালে ‘স্ট্রোক’-এ আক্রান্ত হওয়ার পর জনসমক্ষে আসা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন। শেষের দিকে স্মৃতিও প্রতারণা করছিল। অস্কারজয়ী ‘দ্য আয়রন লেডি’ ছবিতে সেই অসহায় থ্যাচারের ছবি ফুটিয়ে তুলেছিলেন মেরিল স্ট্রিপ।
সোমবার থেকে শুধু স্মৃতিতেই বাসা বাঁধলেন মার্গারেট থ্যাচার। |