বিশ্বের নানা স্থানে যখন যুদ্ধের দুন্দুভি অব্যাহত, তখন রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে অস্ত্র-বাণিজ্য বিষয়ে চুক্তি সম্পাদিত হওয়া একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই চুক্তির লক্ষ্য: অস্ত্র কেনাবেচার উপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। বছরে যে সাত হাজার কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র হাতবদল হইতেছে, তাহার কিছুটা যে মানবাধিকার লঙঘনে লিপ্ত রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীর করায়ত্ত হইতেছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। অস্ত্র কেনাবেচার উপর আম্তর্জাতিক নজরদারি কায়েম হইলে জাতীয় নিরাপত্তা বা অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষার বাহিরে ব্যবহার্য এই সব অস্ত্রের লেনদেন অংশত হইলেও নিয়ন্ত্রিত হইবে। বিভিন্ন মানবাধিকার রক্ষা সংগঠন ও আন্দোলন এই চুক্তিকে স্বভাবতই স্বাগত জানাইয়াছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের ১৫৪টি সদস্য রাষ্ট্রের ভোট যে অস্ত্র-বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে পড়িয়াছে, তাহা চুক্তিটির গুরুত্ব বুঝাইয়া দেয়। বিরোধিতায় ভোট দিয়াছে মাত্রই তিনটি দেশ: ইরান, সিরিয়া ও উত্তর কোরিয়া। দেশগুলির নামেই বুঝা যায়, তাহাদের আপত্তির কারণ। ইহাদের সব কয়টিতেই বাহির হইতে কেনা বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র দেশবাসীরই বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী অংশের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয় বা ব্যবহারের ভয় দেখানো হয়। সিরিয়ায় যে গৃহযুদ্ধ চলিতেছে, অস্ত্র-বাণিজ্য ছাড়া তাহা এক দিনও চলিতে পারিত না। চিনা ও সাবেক রুশ অস্ত্রে সজ্জিত উত্তর কোরিয়াও দেশবাসীর বিদ্রোহের সম্ভাবনা দমিত রাখিয়াছে অস্ত্রশক্তির দাপটেই। ইরান তো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করিতে ক্রমাগত অস্ত্রের উপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু রাশিয়া ও সৌদি আরব-সহ ভারত এবং চিনও রাষ্ট্রপুঞ্জের অস্ত্র-বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে ভোট দেয় নাই, ভোটদানে বিরত থাকিয়াছে। তাহাতে অবশ্য চুক্তিটির অনুমোদনে বাধা ঘটে নাই। চিন বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক, রাশিয়া তাহার আগে আছে। আর ভারত বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারী, অর্থাৎ সব দেশের চেয়ে বেশি অস্ত্র ভারতই কিনিয়া থাকে। অস্ত্র-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে এই দেশগুলির যে স্বার্থ থাকিবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী? ভারতীয় প্রতিনিধির বক্তব্য, চুক্তির বয়ানে অস্ত্রের বেআইনি চোরাচালান, বিশেষত সন্ত্রাসবাদী ও অন্যান্য বেসরকারি গোষ্ঠী বা সংগঠনের হাতে অস্ত্রভাণ্ডার চলিয়া যাওয়া রোধ করিতে কোনও ব্যবস্থার কথা নাই। ভারতের পক্ষে ইহাই যদি ভোটদানে বিরত থাকার কারণ, রাশিয়া, সৌদি আরব বা চিনের ক্ষেত্রে তবে বিপরীতটাই কারণ হইতে পারে। উত্তর-পূর্ব ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী বরাবর চিনা অস্ত্রেই নিজ-নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব বিনাশে উদ্যত। ইদানীং আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীকেও চিনা অস্ত্র ব্যবহার করিতে দেখা যাইতেছে। সৌদি আরবের কাছে কেনা অস্ত্র লইয়া দেশে দেশে জেহাদি জঙ্গিরা রাজনৈতিক ইসলামের সবুজ নিশান উড়াইতেছে।
তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক। বিশ্বের মোট অস্ত্র-বাণিজ্যের ত্রিশ শতাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ওই দেশের শিল্পবিকাশের একটি স্তম্ভই হল অস্ত্র নির্মাণ শিল্প। আন্তর্জাতিক অস্ত্র-বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ আসিলে মার্কিন পুঁজির ক্ষতির শঙ্কা সমূহ। মার্কিন সেনেটে রিপাবলিকান প্রতিনিধিরা ইতিপূর্বে রাষ্ট্রপুঞ্জের চুক্তির বিরোধিতায় প্রস্তাবও লইয়াছেন। প্রভাবশালী ন্যাশনাল রাইফ্ল অ্যাসোসিয়েশন সেনেটে চুক্তির অনুমোদন ঠেকাইতে তাহার প্রতিজ্ঞার কথাও জানাইয়াছে। তথাপি ওবামা প্রশাসন কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের বিতর্ক-আলোচনায় কিংবা ভোটাভুটিতে সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠিতে পারার ঔদার্য দেখাইয়াছে। মার্কিন ব্যবসায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাটিকে রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে লঘু করিয়া দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছে। বিশ্বের বহু দেশে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রও অসামরিক জনগণের মানবাধিকার দলনে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। তবে তাহার প্রত্যক্ষ দায় অস্ত্র ব্যবহারকারীর। অস্ত্র এক হিসাবে নৈর্ব্যক্তিক। তাহাকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে ব্যবহার করা যায়, সংগ্রাম দমনের কাজেও। অস্ত্রের অপব্যবহার রোধের শ্রেষ্ঠ পন্থা তাই অস্ত্র-বাণিজ্যকেই নিয়ন্ত্রণ করা, কালক্রমে অস্ত্রের কেনাবেচা, এমনকী নির্মাণও বন্ধ করিয়া দেওয়া। সেই আদর্শ অবস্থা অবশ্যই দূর অস্ত্, তবু এই চুক্তি যদি দুনিয়াকে তাহার পথে এক পা অগ্রসর করে, তাহাও নগণ্য নয়। |