|
|
|
|
|
|
|
একটাভয় [কষ্ট] লজ্জাঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
|
আমাদের বাড়িটা চিরকালই ছিল হেভি মধ্যবিত্ত, তায় জয়েন্ট ফ্যামিলি। অনেক আত্মীয়-পরিচিত হামেশাই এসে থেকে যেত আমাদের বাড়ি, কেউ পরীক্ষা দিতে তো কেউ অপারেশন করাতে, কেউ কলকাতা বেড়াতে। সব মিলিয়ে যাকে বলে বাহান্নবর্তী পরিবার। তিনটে ঘর, একটা বাথরুম, এই নিয়েই চালাতে হত আমাদের। সকাল থেকে অহরহ বাথরুমের দরজায় গুমাগুম কিল পড়ত, সে যে-ই যাক আর যখনই যাক। এর আপিস, ঘেঁটুগুলোর স্কুল, জেঠিমার পুজোর তাড়া। সকাল গড়িয়ে দুপুর এলেও বাথরুম বেচারা রেহাই পেত না। তখন গরমের দুপুরে সেল্স-গার্ল মাজন বিক্রি করতে এসে ‘মাসিমা, আপনাদের বাথরুমটায় একটু যাব?’ কিংবা সেজপিসির দেওরের প্রচণ্ড বেগ এসে যাওয়ায় মাঝপথে বাস থেকে নেমে পড়েছে আমাদের বাথরুম কাছে হবে বলে। ফলে এক চিলতে বাথরুম খুব ঝক্কি পুইয়েছে সারা জীবন। আমাদের বাথরুম দিয়ে যত জল বয়েছে, গঙ্গায় তত জল আছে কি না সন্দেহ!
এ হেন বাড়ির মেয়ে আমি এক বার এক আত্মীয়ের বাড়ি গেছি। তারা পাক্কা সাহেব, বাড়িও এক্কেবারে ঝাঁ-চকচকে! পালিশ করা লাল মেঝে, টেবিলে ক্রুশের ঢাকনা দেওয়া মৌরি ভেজানো গেলাস, সে-বাড়ির দাদুর কাঠের পাকানো লাঠি, সে-বাড়ির দিদার ফুল-তোলা রুমাল। ঘরের কোনায় টান টান করে পাট করা খবরের কাগজ। তাদের বাড়ি বিজয়ার পর যেতাম, তবে বাথরুম ব্যবহার করার কোনও প্রয়োজন হয়নি কখনও। ঠিক সেই বাড়িতেই সে বছর আমার বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন হল। তখন আমার বয়স আট কি নয়।
একটু দূর থেকে আঙুল তুলে আমাকে একটা বন্ধ দরজা দেখিয়ে দেওয়া হল। দোর ঠেলে ঢুকে গেলাম। ঢুকে হাঁ। এ দিক ও দিক খুঁজছি। লাল শুকনো তকতকে মেঝেওলা ঘরের এক দিকে একটা কল আর বেসিন দেখতে পেলাম বটে, কিন্তু বাথরুম কই? পর্দা দেওয়া জানলা। সেটা সরিয়ে দেখলাম। না, ও দিকেও বাথরুম নেই। মিনিট দশেক ঘরটার মধ্যে খামখা ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম। বাবার কাছ ঘেঁষটে কানে কানে বললাম, বাবা, ওটা বাথরুম নয়। তুমি আমায় বাথরুমটা দেখিয়ে দাও। বাবাও তেমনি। সবার সামনে হো-হো করে হেসে উঠল। বলল, ওটাই তো বাথরুম, তুমি আবার যাও। আমি তো বুড়বক। কাউকে খুব হাত-পা নেড়ে বলে-টলেও বিশ্বাস করাতে পারছি না যে ওটা বাথরুম নয়। ওটা বাথরুম হতে পারে না। ওটা একটা এমনি ঘর, যার এক দিকে একটা বেসিন লাগানো।
আমার কথা শুনে যে যেখানে ছিল খুব হাসাহাসি করতে লাগল। এ তো ভয়ানক গাঁইয়া মেয়ে! দাদা তো তখনই তিষ্ঠোতে দিচ্ছিল না। আমার লজ্জায় কান গরম। তা ছাড়া চেপেই বা কত ক্ষণ রাখব? প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল। তার পর আমায় সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হল সেই ঘরটায়, যেখানকার মেঝে শুকনো এবং দেখিয়ে দেওয়া হল একটা কোণে কাগজে-মোড়া কমোড। আমি তো থ’ বললে খুব কম বলা হয়। বাথরুমে একটুও জল পড়ে নেই, আর কাগজ দিয়ে মুড়ে রাখা কমোড? এর মানে কী? এটা কি ইংরিজি সিনেমা? প্রত্যেক বার ইয়ে করার পর কাগজ দিয়ে মুড়ে রাখতে হয় বুঝি? এ তো হোমওয়ার্কের চেয়েও শক্ত! বাথরুম করব কী, সকলে দল বেঁধে এসে আমার সেই হাঁ করে বাথরুমের চার দিকে তাকানো দেখতে লাগল আর এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। |
|
|
|
|
|