|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন
|
এই ধরনের সমীক্ষা আগে কখনও করিনি, এমন কোনও সমীক্ষার কথা শুনিওনি কোনও দিন। ফেরিওয়ালারা কী ভাবে ডাকছেন, কোন কোন স্বর কোন প্রক্রিয়ায় লাগাচ্ছেন। যে জিনিস তাঁরা বেচছেন বা কিনছেন, তার সঙ্গে তাঁদের ডাকের সম্পর্ক আছে কি না।
দক্ষিণ কলকাতার বৈষ্ণবঘাটা বাইলেনে এই ডাকগুলি শুনে শুনে স্বরলিপি করেছিলাম আমি ২০১২ সালের ডিসেম্বর আর ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে। টের পেয়েছিলাম প্রায় সব ফেরিওয়ালাই ‘জি-শার্প’ বা ‘এ’ স্কেলে ডাক ছাড়ছেন। ওই দুই স্কেলের তারসপ্তকের সা তাঁদের সাধারণ লক্ষ্য। উদ্দেশ্য গান গাওয়া নয়, কিছু একটা বিক্রি করার জন্য পাড়ার সকলকে চেঁচিয়ে জানান দেওয়া। অথচ সব ফেরিওয়ালাই গলায় ঠিক পরদা লাগানোর ব্যাপারে যত্নবান, সতর্ক আজকাল অনেক প্রতিষ্ঠিত গায়ক-গায়িকাও যা নন। অন্তত দশ দিন সমীক্ষা চালানোর সময়ে এক জনকেও পাইনি, যিনি একটি পরদাও হেলাফেলা করে লাগাচ্ছেন। তিন-চারটি পরদার মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও প্রতিটি স্বরকে তাঁরা দিচ্ছেন সমান গুরুত্ব।
গত সংখ্যায় সিদ্ধান্তে এসেছিলাম ফেরিওয়ালারা তারসপ্তকের সা থেকে কখনও শুদ্ধ নি-তে বা শুদ্ধ নি থেকে তারের সা-তে যাচ্ছেন না। নিখাদ মানেই যেন কোমল নিখাদ। তেমনই রেখাব ও গান্ধারের বেলা শুদ্ধ কোমলের যে-কোনও একটি হতে পারে। দেখলাম, রে বা গা শুদ্ধ বা কোমল হওয়ার সঙ্গে যে বস্তুটি ফেরি করা হচ্ছে, তার কোনও সম্পর্ক নেই। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
বেশির ভাগ ফেরিওয়ালা কাগজ কিনতে আগ্রহী হলেও এক দিন সকালে এক উত্তীর্ণ-যৌবন ব্যক্তিকে সজোরে হাঁক পাড়তে শুনলাম ‘ইনভার্টার, পুরনো ভোল্টেজ স্টেবিলাইজার, পুরনো কম্পিউটার’ বলে। এবং তিনি প্রথমে তারসপ্তকের সা ও তার পর কোমল নিখাদে একটানা থাকলেন। ব্যক্তিটি যা করছিলেন, তা আমি নিজে অনুশীলন করেছি এক সময়ে: এক ভাবে একই পরদায় ঠায় দাঁড়িয়ে নানান শব্দ উচ্চারণ করে যাওয়া ওজনে কোনও হেরফের না ঘটিয়ে। সংগীত-শিক্ষার্থীরা এটি অনুশীলন করে দেখতে পারেন। একই পরদায় নানান শব্দ একটানা একই ওজনে বলে গেলে বা স্বরের সামান্য হেরফের ঘটিয়ে ওজন পালটে পালটে উচ্চারণ করলে শ্রোতার মনে কী হয়, তা মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর উপস্থাপনায় মহিষাসুরমর্দিনীর চণ্ডীপাঠ ও ভাষ্য যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা জানেন। বিভিন্ন যন্ত্রের নাম গলার ওজন একই রেখে স্পষ্ট ভাবে একই পরদায় পরপর করে যাওয়ার আইডিয়াটা এই ব্যক্তির মাথায় এল কী করে? সেই বিখ্যাত বেতার অনুষ্ঠান? এই ব্যক্তি, দেখছি, প্রথমে তারের সা-তে দাঁড়িয়ে আছেন ঠায়। তার পর তিনি মাঝসপ্তকের কোমল নি-তে শুরু করছেন এবং শেষ মুহূর্তে ছোট মিড় দিয়ে তারের সা-তে ফিরে যাচ্ছেন। লক্ষ করার মতো, প্রায় প্রত্যেক ফেরিওয়ালা স্বরের স্বল্পতা সত্ত্বেও সুরের ছোট্ট একটা ছবি তৈরি করতে চেষ্টা করছেন।
এক ফুলঝাড়ুওয়ালা মধ্য সপ্তকের সা থেকে শুরু করলেন যথেষ্ট গম্ভীর গলায়। লক্ষণীয় ব্যতিক্রম। তারসপ্তকের সা নয়, মধ্য সপ্তকের সা। এঁর কি ঠান্ডা লেগে গিয়েছে? গলাটা আজ তেমন খুলছে না? উঁহু। স্বর লাগানোর ধরন থেকে মনে হচ্ছে এই সপ্তক-অবস্থানেই তিনি স্বরাট। ব্যারিটোন। গম্ভীর গলায় তিনি ডাকছেন: সা-সা- -/ সা-সা- -। কথা হল: ফুল-ঝাড়ু/ফুল-ঝাড়ু। এই ভাবে দু’বার ডাকার পর তৃতীয় ফুলঝাড়ুর ‘ঝাড়ু’ দাঁড়াচ্ছে কোমল গান্ধারে। সুরের একটি লাইন কিন্তু তৈরি হয়ে গেল: সা-সা- -/সা-সা- -/ সা-জ্ঞা- -। দুনিয়ায় এমন গান একাধিক আছে, যার প্রথম লাইনের সুরটি এই রকম।
মধ্য সপ্তকের সা থেকে কোমল গা-এ যাওয়া গম্ভীর গলাটির একেবারে উলটো দিকে ‘জামাপ্যান্টের চেন বানানেওলা’। তরুণের গলা, উঁচু গ্রামে। ‘ব্যাগের চেন সারাবে চেন সারাবে চেন সারাবে।’ এটি তিনি তিন বার গাইছেন। প্রতিটি ‘চেন’ কোমল নি, বাকি সব তারের সা। ‘চেন’ শব্দটি গাইছেন তিনি সামান্য একটু ধাক্কা দিয়ে। তিনটি বাক্য গাইছেন আট মাত্রার তালের কাঠামোয়। তিন বার ব্যাগের চেন গাওয়ার পর এই যুবক হঠাৎ গলাটি তারের সা-এ রেখে গেয়ে যাচ্ছেন ‘ব্যাগ সারাবে প্যান্ট সারাবে প্যান্ট সারাবে।’ অন্য কোনও স্বরের বালাই নেই। তাজা খোলা গলায় গাওয়া কথাগুলো পাড়াটাকে দখল করছে যেন। এমন সময়ে, পাশের বাড়ি থেকে শোনা গেল একটি মেয়ের গলা: ‘এই যে!’ ছেলেটির খদ্দের। ডাকতে গিয়ে মেয়েটি ‘এই যে’ কথা দু’টিকে বসাচ্ছেন ‘ণা-ণপা’ এই সুরে, ছেলেটির স্কেল বজায় রেখে। ফলে দু’জনের ভূমিকা মিলিয়ে সুরটি দাঁড়াচ্ছে: র্সা র্সা র্সা র্সা/ র্সা র্সা র্সা র্সা/ণা-ণপা। আমার কানে যা পৌঁছাল, তাঁদের কানেও তা পৌঁছনোর কথা। মেয়েটি কি ইচ্ছে করে ছেলেটির স্কেলে সুর মিলিয়ে ‘এই যে’ বলে তাঁকে ডেকেছেন কোমল নি ও পা এই দুই স্বর প্রয়োগ করে? না কি এমনিই ঘটে গিয়েছে ব্যাপারটা?
রিকশার হর্ন যে কী আশ্চর্য ভাবে ফেরিওয়ালার ডাকের সুরের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করতে পারে আগে কখনও খেয়াল করিনি। ইলেকট্রনিক তানপুরায় ‘এ’ পরদাটি বেজে চলেছে। এক কাগজবোতলওয়ালা যেন সেই পরদায় গলা মিলিয়ে ডাক ছাড়ছেন: তিন বার তিনটি মাত্রায় তারসপ্তকে কোমল গান্ধার, তার পর এক মাত্রার বিরাম। এই স্বরগুলি ব্যবহার করছেন তিনি ‘কাগজ’ কথাটির জন্য। এর পর ‘বোতল-আলা’ আর ‘পেপার-আলা’ কথা দু’টি গাইছেন দু’বারে চার মাত্রায়: তারসপ্তকের সা, কোমল গা, শুদ্ধ রে আর সা এই চারটি স্বরে।
যত জন ফেরিওয়ালার ডাকের স্বরলিপি করেছি, তাঁদের মধ্যে এঁর গলাই সবচেয়ে সুরেলা। কোমল গান্ধারের প্রয়োগ লক্ষ করার মতো। শুদ্ধ গান্ধারে এই উদাস ভাবটা আসত না। আমাদের পল্লিগীতিতে কোমল গান্ধার যদি আসে তো হয় ভৈরবী রাগের স্বরসমষ্টিতে আর নয়তো শুদ্ধ গান্ধার ও কোমল নিখাদের অনুষঙ্গে। আব্বাসউদ্দিন আহ্মেদের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে’-তে যেমন, কাহিনির বর্ণনায় কোমল গান্ধার রয়েছে শুদ্ধ রেখাবের সঙ্গে। কিন্তু পাথরের বুকেও কান্না জাগিয়ে তোলা ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’-র বেলা অমোঘ কোমল নিখাদ যেই এল, অমনি শুদ্ধ গান্ধার। আমাদের এই ফেরিওয়ালা কিন্তু পুনরাবৃত্তির সময়ে তারের সা থেকে মাঝসপ্তকের কোমল নিখাদে এসেও ‘কাগজ’ কথাটি বলার সময়ে গলায় কোমল গান্ধার লাগাচ্ছেন।
বাংলার কোনও কোনও শ্যামাসংগীতে ভীমপলশ্রীর প্রভাব থাকায় কোমল নি, শুদ্ধ ধা, পা, শুদ্ধ মা, কোমল গা ও শুদ্ধ রে স্বরগুলিকে পাওয়া যায়। তবে কি এঁর মনে আজও সেই রকম কোনও সুরের স্মৃতি থেকে গিয়েছে? শ্যামাসংগীত বিষয়টি আমরা কবে ভুলে গিয়েছি। যদি কেউ মনে রেখে থাকেন তো, ভয় হয়, ‘মায়ের নাম’ হিসেবেই বেশি, সংগীত হিসেবে কম। আজকের এই বাঙালি ফেরিওয়ালার সুরেলা ডাকের মধ্যে কি উঁকি দিচ্ছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবে ভুলে যাওয়া বাংলার সুরের এক সাবেক অনুষঙ্গ? কোমল নিখাদ, শুদ্ধ রেখাব, কোমল গান্ধার?
হবি-তো-হ, এক রিকশাওয়ালা ওই সুরের পর তিন বার হর্ন বাজালেন। ফেরিওয়ালার ‘সা’টিকে ‘সা’ মেনে: চার মাত্রা করে তিন বার তারসপ্তকের সা (দুই মাত্রা) আর তারসপ্তকের শুদ্ধ রে (দুই মাত্রা)। এই মিল কী করে ঘটে যায় কলকাতাই হয়তো জানে। |
|
|
|
|
|