এরিক মারিয়া রেমার্ক নামের জার্মান তরুণ যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঠে ‘দেশ’-এর জন্য লড়াই করছিলেন, প্রায় সেই সময়েই রবীন্দ্রনাথ লিখছিলেন তাঁর ঘরে বাইরে উপন্যাস। রেমার্ক জন্মেছিলেন ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে খেটে খাওয়া পরিবারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ায় স্কুলের পড়া শিকেয় তুলে আঠারো বছর বয়েসে যুদ্ধে যেতে হল। যুদ্ধে গিয়ে রেমার্কের স্বপ্নভঙ্গ হল। ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট যে কী ভয়ংকর তা এই রংরুট টের পেলেন। আর সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেললেন তাঁর অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট বইতে। ১৯২৮-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে জার্মানির একটি কাগজে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হল, ১৯২৯-এর জানুয়ারি মাসে বই, আর ১৯৩০-এ একই নামে চলচ্চিত্র। |
দেশের বা আদর্শের নাম করে যুদ্ধে, মেঠো লড়াইতে বাচ্চাদের ঠেলে দেয় যারা আর নিজেরা নিরাপদে দেশ-জাগানিয়া বক্তৃতায় মত্ত থাকে, তাদের স্বরূপ রেমার্কের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। জার্মান, ফরাসি, ব্রিটিশ সব দেশের সাধারণ মানুষই কিন্তু স্বাভাবিক যুদ্ধবিহীন জীবন যাপন করতে চায়, কেউ তারা লড়াই-খ্যাপা নয়। রেমার্কের উপন্যাসে ১৯ বছরের পল বোমার-এর মনে হয়েছিল এই কথাটা। তার বন্ধু মুলার ইস্কুলের বই পিঠে করে বয়ে বেড়ায়, যখন কামানের গোলা পড়ে তখন বিড়বিড় করে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র আওড়ায়। যুদ্ধ থামলেই সে নাকি পরীক্ষা দেবে। চাষি ডেটারিং লড়াইতে এসে খেতখামারের কথা ভাবে। আহত ঘোড়ার আর্তনাদ এই কৃষক মানুষটি সইতে পারে না। বন্ধু কেমারিখ-এর পা কাটা যায়। তার মৃত্যু-মুহূর্তে ডাক্তার বলে, “কে সে?’’ আরদালি জানায়, “বেড নং ২৬, পা কাটা হয়েছে যার।” ডাক্তার মুখ বেঁকায়, “পা তো কেটেছি পাঁচটা আজ এক দিনেই।” এই ইস্কুল-বালকদের চাগিয়ে তুলেছিল ক্যান্টোরেক। অত্যন্ত কড়া লোক। বেঁটেখাটো মানুষ। মুখখানা ইঁদুরের মতো। যুদ্ধ বাধলে তার কাজ ছিল ড্রিলের মাঠে ছেলেদের নামিয়ে লম্বা লম্বা লেকচার দেওয়া। আজ যুদ্ধের মাঝে এসে পল বোমারদের মনে হয় হাজার হাজার ক্যান্টোরেক আছে দুনিয়ায়। তারা যুদ্ধে মারা পড়বে, গোলার আঘাতে হয়ে যাবে থেঁতলানো মাংসপিণ্ড। ক্যান্টোরেক বুক চিতিয়ে তবু বলে বেড়াবে, সে ঠিকই করেছিল। এখন তাদের বয়স কুড়িও নয়। ক্যান্টোরেকের বুকনিতে লোহায়-গড়া নওজওয়ানের মতো যুদ্ধে এসেছিল তারা। সে সব অতীতের জিনিস। মৃত্যুর মুখোমুখি তারা বুড়িয়ে গেছে। রেমার্কের এই আখ্যানের শেষে দেখা গেল, পল বোমার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মাটিতে।
রেমার্কের এই যুদ্ধবিরোধী আখ্যান আদর্শের নামে বালক ও তরুণদের চাগিয়ে তোলা মানুষদের সমালোচনা। উপন্যাসের সিকোয়েল লিখলেন রেমার্ক। দ্য রোড ব্যাক নামের সেই বইটি স্বভাবতই নাত্সি জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় রোষের স্বীকার। রেমার্ককে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হল প্রাণে বাঁচার জন্য। তাঁর সহোদরা নাত্সি জার্মানিতে ফ্যাসিস্টদের দমনের কবলে পড়েছিলেন।
রেমার্ক যখন যুদ্ধ করছিলেন তখন ইংরেজ উপনিবেশ ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঘরে বাইরে উপন্যাসে লিখছিলেন বালক অমূল্যের কথা। ১৯১৬-র ঘরে বাইরে উপন্যাসের বালক অমূল্য রেমার্কের মতো লড়াইয়ের ময়দানে যায়নি। তবে ইংরেজ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্তেজনায় শামিল হয়েছিল। নিরাপদ দূরত্বে থেকে চমত্কার বক্তৃতায় বালকদের বিপ্লববাদের নামে চাগিয়ে তুলেছিল সন্দীপ। (ক্যান্টোরেকের মতো সন্দীপ বেঁটে নয় অবশ্য যথেষ্ট সুপুরুষ, রমণীমোহনও।) অমূল্য পল বোমারের মতোই পরিণতির শিকার। পুরোপুরি যুদ্ধে যেতে হয়নি বলে হয়তো বাঙালি বালক অমূল্য এই লড়াইবাজির মিথ্যেটুকু বুঝে উঠতে পারেনি। ঢিল ছুড়ে মেমসাহেব মেরে ভেবেছে দেশের শত্রু নিকেশ হল। তবে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসেও এই অবুঝ বালক পরিস্থিতির টানে মারা গেল। উপন্যাসের শেষে আমরা জানলাম সে কথা। “আর অমূল্যবাবু?/ তাঁর বুকে গুলি লেগেছিল, তাঁর হয়ে গেছে।” রেমার্ক আর রবীন্দ্রনাথের লেখার বিষয়ের কোনও মিল নেই বটে, তবে পশ্চিমে যুদ্ধের ময়দানে আর এ দেশে বিপ্লবী আন্দোলনে দেশ-জাগানিয়ারা বাচ্চাদেরকে একই ভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।
শিক্ষকতা করি। শ্রেণিকক্ষে যাদের পড়াই তাদের কত আর বয়স? উনিশ, কুড়ি, একুশ... যদি দেখি, কাল যে ছিল ক্লাসে আজ সে নেই; তার জায়গা ফাঁকা; রাষ্ট্র, পরিস্থিতি, উত্তেজনা, ক্ষমতা গিলে ফেলেছে তাকে, ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর দিকে, কী করব তখন? রবীন্দ্রনাথ অনেক স্নেহ আর প্রশ্রয় নিয়ে এই তরুণদের ‘অবিবেচক’ বলেছিলেন। লিখেছিলেন, বুড়োটে স্থিতিকামী বিবেচকরা নয়, এই সবুজ অবিবেচকরাই তো কিছু করে। ঘা মেরে বাঁচায়। সে তো খুবই সত্যি কথা। স্বার্থহীন প্রাণের স্ফূর্তি তো এদেরই থাকে। তাই এদের সেলাম না করে উপায় নেই। সেলাম করব। কিন্তু এটাও তো সত্যি, পাকা-মাথারা ব্যবহার করে এদের। পল বোমারদের ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে।
সেটা ১৯৮২ সাল। রেমার্কের উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ রাহা। আশির দশকের শেষের দিকে আমি যখন নিতান্তই স্কুল-বালক, সেই চমত্কার অনুবাদ হাতে পেয়েছিলাম। কোনও অভিভাবক দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, “এর মূলে আছে শাসকেরা। তারাই বাধায় যুদ্ধ। সাধারণ লোকের মত কেউ নেয় না। এ দেশেও না, ও দেশেও না।... কালো কালো রক্তের চাপড়া বনের ভিতর। ছেঁড়া ছেঁড়া ধড়, ছেঁড়া ছেঁড়া হাত-পা। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যাই।” সেই বাক্যগুলো এখন কানে বাজে। কায়েমি ক্ষমতাতন্ত্র সে যে দলেরই হোক না কেন, যে আদর্শের ধুয়ো তুলেই আসুক না কেন এলে কিন্তু একই ভাবে শিকার হিসেবে ব্যবহার করে তরুণদের। মৃত পল বোমার এ কথা বুঝেছিল। রবীন্দ্রনাথের অমূল্য বুঝেছিল কি না কে জানে! তবে ছাত্রদের নানা ভাবে সমাজগঠনমূলক কাজে উত্সাহ দিতেন যে রবীন্দ্রনাথ, তিনি অন্তত তাঁদের অন্ধ ভাবে ক্ষমতাতন্ত্রের শিকার হওয়ার বিপদ থেকে সাবধান করে দিয়েছিলেন।
|