কংগ্রেসের পরবর্তী নেতা কে, সে প্রশ্নের উত্তর লইয়া কোনও সংশয় গত এক দশকে ছিল না। অযাচিত যৌবরাজ্য যাঁহাতে সমর্পিত হইয়াছিল, সেই রাহুল গাঁধী কবে প্রকৃত নেতা হইয়া উঠিবেন, প্রশ্ন ছিল তাহাই। সেই প্রশ্নের আংশিক উত্তর গত জানুয়ারিতে কংগ্রেসের অধিবেশনে জয়পুর শুনিয়াছিল। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, দিল্লির এক বণিকসভার সম্মেলনে পাওয়া গেল। রাহুল কী বলিলেন, তাহা গৌণ। তিনি কোথায়, কাহাকে উদ্দেশ করিয়া, কোন ভঙ্গিতে কথা বলিলেন, তাঁহার বক্তব্যের তাত্পর্য সেখানে। রাহুলের রাজনৈতিক জীবন প্রায় এক দশক অতিক্রান্ত। পদবির উত্তরাধিকার ব্যতীত তাঁহার যতটুকু রাজনৈতিক পরিচয় এই এক দশকে নির্মিত হইয়াছে, তাহা যেন ক্ষমতার অলিন্দে কিঞ্চিত্ আড়ষ্ট, বলা অপেক্ষা শোনায় স্বচ্ছন্দ, আম আদমি-কেন্দ্রিক। জরুরি রাজনৈতিক পরিচয়, কিন্তু একুশ শতকের ভারতে নেতা হইয়া উঠিবার পক্ষে যথেষ্ট নহে।
এইখানেই তাঁহার দিল্লির বণিকসভায় প্রদত্ত ভাষণের গুরুত্ব। যাঁহারা তাঁহার ভাষণ শুনিতে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা দেশের শিল্পমহলের সর্বোচ্চ স্তরের প্রতিনিধি। যে ভঙ্গিতে রাহুল তাঁহাদের সম্মুখে বক্তৃতা করিয়াছেন, তাঁহাদের প্রশ্নের উত্তর করিয়াছেন, তাহাতে একটি কথা স্পষ্ট। তিনি বুঝিয়াছেন, আম আদমি যেমন ভারত, শিল্পমহলও তেমনই। জয়পুরে তাঁহার মুখে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকাঙ্ক্ষার কথা শোনা গিয়াছিল। অস্যার্থ, দেশনেতা হইবার যে আবশ্যিক শর্ত, অর্থাত্ সবাইকে লইয়া চলিতে পারিবার ক্ষমতা, রাহুল তাহার প্রাথমিক পাঠটি আত্মস্থ করিতে পারিয়াছেন। লক্ষণীয়, রাহুল কিন্তু বণিকসভার সহিত সংযোগ গড়িতে গিয়া তাঁহার আম আদমি-কেন্দ্রিক রাজনীতির বয়ানটি বিসর্জন দেন নাই। বরং তিনি ব্যাখ্যা করিয়াছেন, কেন দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির জন্যও উন্নয়নকে যথাসম্ভব সর্বজনীন করিতে হইবে। ২০১৪ সালে যিনি তাঁহার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হইবেন বলিয়া অনুমান, গুজরাতের সেই বি জে পি নেতার উন্নয়নী প্রচারের ভাব ও ভঙ্গির সহিত রাহুলের পার্থক্যটি চোখ এড়াইবার নহে। নিজস্ব রাজনীতির ধারা হইতে বিচ্যুত না হওয়া এবং দেশের চাহিদাকে সেই ধারাতে মিলাইতে পারিবার ক্ষমতা প্রকৃত নেতার অভিজ্ঞান। নীতি নির্ধারণের দায়ভার পাইলে সেই দায়িত্ব পালনে রাহুল কতখানি সফল হইবেন, তাহা ভবিষ্যত্ই বলিবে, কিন্তু আপাতত তিনি সেই পথে একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ করিলেন। নেতৃত্বের ক্ষমতাটি সহজাত, এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভারত বহু দেখিয়াছে। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর উদাহরণটি সর্বাগ্রে স্মর্তব্য। ভিন্ন প্রেক্ষিতে এবং ভিন্ন অর্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাহরণও। কিন্তু নেতৃত্বের ক্ষমতা সহজাত হইলে তবেই কাহারও নেতা হইবার অধিকার জন্মে, এমন দাবি অযৌক্তিক। ভারতে এই দাবিটি বিরল নহে, কিন্তু ঘটনা ইহাই যে, কিছু নেতা জন্মান, বাকি নেতাদের গড়িয়া পিটিয়া লইতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় দেশে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে বিভিন্ন ভাবে নেতৃত্বের যোগ্য করিয়া তুলিয়া জনসমক্ষে পেশ করাই দস্তুর। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হইতে পারেন, এমন জনপ্রতিনিধিদের ‘গ্রুমিং’-এর প্রক্রিয়া সেই দেশে জোরকদমে চলিতেছে। রাহুল গাঁধীর মাধ্যমে ভারতেও এই পেশাদারিত্বের বোধন হইল। কংগ্রেসের অবশ্যই কৃতিত্ব প্রাপ্য। পারিবারিক উত্তরাধিকার রাহুলের সহায় হইয়াছে, কিন্তু তিনি সেইটুকুতেই থামেন নাই। তিনি ক্রমশ যোগ্য হইয়া উঠিবার চেষ্টা করিতেছেন। চেষ্টা সফল হইবে কি না, ক্রমশ প্রকাশ্য। |