|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
রেডিয়ো শোনার স্মৃতি |
সৌরীন ভট্টাচার্য |
সংবাদ কথায় বেতার জগৎ ১৯২৯-৪৪, উপস্থাপনা ও সংকলন ইন্দিরা বিশ্বাস। ছাতিম বুকস, ৪৯৫.০০
কলকাতা বেতার, সম্পা. ভবেশ দাস, প্রভাতকুমার দাস। পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, ৫০০.০০ |
সাহেবেরা যদি পাখী মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই।’ এই বঙ্কিমি তিরস্কার আমাদের শিরোধার্য। একটু একটু করে সে পাপ স্খালনের চেষ্টা শুরু হয়েছে অনেকদিন। তবে গোটা জনগোষ্ঠীর পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত রচনা করা কি আর অত সহজ কাজ। কিছু চেষ্টা যে তাও হয় এবং হচ্ছে, সেটুকু অবশ্যই লক্ষ করা চাই। আমাদের বেতারের ইতিহাস নিয়ে দুটো বড় মাপের বই কাছাকাছি সময়ে রচিত হল। এটা কম কথা নয়। এবং সুখের কথা যে, বই দুটোর জাত আলাদা। ইন্দিরা বিশ্বাসের সংকলিত বইয়ের আয়তন ৩৯৫ পৃষ্ঠা। আর ভবেশ দাস ও প্রভাতকুমার দাস সম্পাদিত বইয়ের আয়তন ৫৮৩ পৃষ্ঠা। বোঝাই যাচ্ছে, বড় মাপের আয়োজন।
বলেছি বই দুটো আলাদা জাতের। সংবাদ কথায় বেতার জগৎ তথ্যভিত্তিক গবেষণালব্ধ সংকলন। বেতার শ্রাব্য মাধ্যম। কেউ কোনও কথা বললেন। বেতার তরঙ্গবাহিত হয়ে সে কথা আমাদের কাছে পৌঁছল। আমরা কেউ শুনলাম। মিটে গেল। কিন্তু শুধু এটুকু হলে তো চলবে না। পাখি মারারও ইতিহাস চাই। ইতিহাসের জন্য তথ্যের চিহ্ন চাই। যে তথ্য কোথাও কোনও চিহ্ন রাখে না, সে তথ্য নিয়ে ইতিহাস রচয়িতাকে বিব্রত হতেই হয়। সরাসরি কিছু না পেলে বাঁকা পথে খুঁজে দেখতে হয় তথ্যের অন্তত আভাসে পৌঁছনো যায় কী ভাবে। বলা-কথা যখন বেতার তরঙ্গবাহিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন যদি শব্দধারক যন্ত্রের সাহায্যে তাকে ধরে ফেলা যায় আর সে শব্দ যদি ভবিষ্যতের জন্য রক্ষা করা যায়, তা হলে ইতিহাসের সুরাহা কিছুটা হতে পারে। কিন্তু প্রযুক্তির এতটা সহায়তা তো একদিনে পাওয়া যায়নি, যাওয়ার কথাও না। রেকর্ড-করা অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয় চল্লিশের দশকের গোড়ার দিক থেকে। ১৯৪০-এ রবীন্দ্রনাথের কিছু অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে রেকর্ড করে এনে সম্প্রচারিত হয়েছিল। ১৯৩৭-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সমাবর্তন ভাষণ বেতার কেন্দ্র ডিস্ক রেকর্ড করে সম্প্রচার করেছিল।
দুটো বই-ই মূলত সংকলন। প্রথম বইয়ে আছে ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকা থেকে বেশ বিস্তারিত রচনা সংকলন। সংকলিত রচনাগুলি সাজানো আছে বিষয় অনুসারে। সঙ্গে আছে উপস্থাপনা অংশে সঙ্গ অনুষঙ্গ প্রসঙ্গ ও তথ্যটীকা ইত্যাদি নিয়ে প্রায় শ-খানেক পৃষ্ঠার সম্পাদকীয় লেখা। চলে-যাওয়া সময়ের অনুভববেদ্য অনেক কথা আছে এ অংশে। বেতারের সরাসরি সম্প্রচারের যুগে কথক বা শিল্পীর গলার কাশির আওয়াজ পেলে তখনকার শ্রোতা যে খুশি হয়ে উঠতেন, সে খবর এত বছর সময় পেরিয়ে এসে শোনানোর মতো কথা বটে। ওই কাশি ছিল নিতান্ত স্বাভাবিকতার চিহ্ন। শ্রোতারা তাতে করে সজীব মানুষের স্পর্শ পেতেন। আজ আমরা পরিশীলিত শব্দপ্রয়োগে এতই অভ্যস্ত যে ওসব শব্দে আমাদের অসুবিধা হয়। ইতিহাসের এসব চিহ্ন পেতে হয়। আবার বেতারের অশরীরী শব্দে একদিন ভূতের ভয়ও জাগত বই কি। |
|
আকাশবাণীর বেতার-নাটকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গঙ্গোপাধ্যায়,
দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্য শিল্পীরা। পরিমল গোস্বামীর তোলা ছবি। |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বেতারে অক্ষশক্তির জয়ের খবর পেলে সাধারণ মানুষ যে উল্লাসে ফেটে পড়তেন, এ কথা আজ জানার দরকার আছে বই কি। আজ বর্তমানের চোখে এই অক্ষশক্তি ফ্যাসিবাদী নৃশংসতা ও বর্বরতার জন্য ধিক্কৃত। এ ধিক্কার প্রায় সর্বজনিক। কিন্তু সে দিনের কলকাতায় জনমনের অবস্থা ছিল ভিন্ন। এ কথা তখনকার আরও অন্য অনেকের স্মৃতির সুবাদেও আমরা জানতে পারি। ইংরেজের শত্রু আমাদের শত্রু। এই সরল বিশ্বাসে আমরা তখন এতটাই আশ্রিত ছিলাম যে ইতিহাসের অন্য কোনও বড় গল্প তখন আমাদের টানতে পারেনি। এ ধরনের অসুবিধার সবটুকু মিটমাট আজও হয়নি, হওয়ার কথাও না। ইতিহাসের একটা সময়ের মন অন্য সময়ের মন থেকে এতটাই সরে যায় যে এ ওকে আর সহজে ছুঁতে পারে না। উনিশ শতকের অনেক মনীষীর লেখায় ইংরেজ আমলের ‘সুশাসন’-এর মসৃণ প্রশস্তি পড়তে গেলে আজ এমনই বোধ হয়। ইতিহাসের সময়ের কথা খেয়াল রাখতে হয়।
দ্বিতীয় বইটিও রচনা সংকলন। কিন্তু কোনও একটা নির্দিষ্ট পত্রিকা থেকে সংকলিত নয়। সংকলনের কালপরিধি ১৯২৭-’৭৭। পুরনো ও নতুন মিলিয়ে এত রকম লেখা আছে এখানে যে কলকাতা বেতারের বেড়ে ওঠা ও পরিণতিতে পৌঁছনোর গল্পটা বেশ ধরা যায়। প্রয়াত ঐতিহাসিক পার্থসারথি গুপ্তের ১৯৮৮-র সখারাম গণেশ দেউস্কর বক্তৃতার পুনর্মুদ্রণ পাওয়া যাচ্ছে এখানে সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বচ্ছন্দ অনুবাদে। ব্রিটেনে ও আমাদের এখানে বেতারের ব্যবহার প্রায় সমসাময়িক হলেও দুই সমাজে তার বিকাশের ইতিহাস রীতিমতো আলাদা। স্বাভাবিক। সেই ভিন্নতার বিশ্লেষণ আছে এই রচনায়। বিলেতে অল্পদিনের বেসরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৯২৬-এই কাজ শুরু করে সরকারি ক্ষেত্রের স্বশাসিত সংস্থা বি বি সি। ভারতের অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো কাজ শুরু করে এর প্রায় ন’বছর পরে। কেন্দ্রীয় সরকারি বিভাগ হিসেবে। এবং এখানে সবটা ছিল ১৯৩৫-এর ভারত সরকার পরিচালনার আইনি কাঠামোর মধ্যে। পার্থসারথি গুপ্তর রচনা ভারতে বেতার সম্প্রচারের প্রশাসনিক প্রেক্ষাপট বুঝতে যেমন সাহায্য করে, তেমনই তিরিশ-চল্লিশ দশকের ভারতীয় রাজনীতির টানাপড়েন ও সম্প্রচারে তার প্রভাবের আন্দাজও বেশ পাওয়া যায় ওই লেখা থেকে।
পার্থসারথির বিদ্যায়তনিক মেজাজের রচনার পাশাপাশি ইন্দিরা বিশ্বাস সংকলিত রচনার মধ্যে উল্লেখ করা চলে মনোমোহন ঘোষের কয়েকটি লেখা। ওঁর রচনায় বিদেশি বেতারের অনেক কৌতূহলোদ্দীপক খবর পাওয়া যায়। চিনে বেতার সম্প্রচার শুরু হয় ১৯২৮ নাগাদ। কুয়োমিন্টাং শাসনকালেও শক্তিশালী বেতারযন্ত্রের সাহায্যে রাজনৈতিক প্রচারের উপর খুব জোর ছিল। তার জন্য শ্রোতারা বিরক্তও হত। নাটক বা অন্যান্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য বক্তৃতা করার চল ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর সামরিক প্রসঙ্গের বেতারভাষ্য খুব সঙ্গত কারণেই বিখ্যাত। সে রকম অনেকগুলি লেখা আছে ইন্দিরার সংকলনে। নাতসি জার্মানি ও ফ্যাসিবাদ নিয়ে এখানে তৎকালীন যে-মন বেশ প্রকট ছিল, সেই প্রেক্ষিতে ওই সব বেতার আলোচনা খুব জরুরি।
কলকাতা বেতার বইতেও অন্য মেজাজের বেশ কিছু লেখা আছে। ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকা থেকে সংকলিত কয়েকটি রচনার প্রথমটি বুদ্ধদেব বসুর। ১৯৪২-এ লেখা। পারমাণবিক কেলেঙ্কারি তখনও অচেনা। তীব্র আবেগে বুদ্ধদেব বেতারের দিকে তাকাচ্ছেন বিশ্বশান্তির আশায়। অথচ জানেন না যে, শান্তি না এলে বেতার তার পূর্ণ পরিণতিতে কখনও পৌঁছবে না। বর্তমান সময়ের আরও অনেকের লেখা আছে। রেডিয়ো শোনার স্মৃতি। আছে বেতারের গান ও নাটক নিয়ে লেখা। বেতার নাটক নিয়ে অনেকের সংশয় ছিল, হয়তো এখনও আছে। এ সব লেখা তাই বিচারশীল মন নিয়ে পড়ার অবকাশ আছে।
দুটো বইতেই আছে প্রচুর পুরনো আলোকচিত্র। আলাদা করে শুধু সেটুকুই যথেষ্ট বড় সম্পদ। দুটো বই মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো মতো ছবি আছে। বেশির ভাগই ফোটোগ্রাফ। ইন্দিরার বইয়ে বিষয়ের ছবি বেশি আর অন্য বইটায় ব্যক্তি প্রতিকৃতি। তথ্য ও পঞ্জি নিয়ে বই দুটো প্রায় আকর গ্রন্থের শামিল। |
|
|
|
|
|