আফগানিস্তানে মার্কিন ও বহুজাতিক নেটো বাহিনীর দেশে ফিরিবার দিন যত ঘনাইয়া আসিতেছে, ততই তালিবানি জঙ্গিদের হামলাও বাড়িয়া চলিয়াছে। ১১ বছর হইয়া গিয়াছে, তালিবানদের শায়েস্তা করিতে মার্কিন নৌসেনারা আফগান ভূখণ্ডে অবতীর্ণ হইয়াছিল। তাহাদের ঘরে ফেরার সময়েও দেখা যাইতেছে, তালিবান আগের মতোই অপ্রতিরোধ্য এবং হয়তো তালিবান কমান্ডারদের হাতেই কাবুলের ভাগ্য সঁপিয়া দিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিতে হইবে। ইহাকে নিয়তির পরিহাস বলা যাইতে পারে। তবে এই নিয়তি ওবামা প্রশাসনও কার্যত মানিয়া লইয়াছে। বস্তুত, প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আফগান অভিযান তাঁহার উত্তরসূরি আদপেই অনুমোদন করেন নাই। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যেমন, নির্বাচনোত্তর শাসন পরিচালনার সময়েও তেমনই বারাক ওবামার লক্ষ্যই থাকিয়াছে, কত দ্রুত কাবুল হইতে মার্কিন বাহিনীকে ফেরানো যায়। সমস্যা দেখা দিয়াছে মার্কিন-বিযুক্ত শূন্যতা ভরাট করার পদ্ধতি লইয়া। বর্তমান আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই স্বভাবতই চাহিতেছেন, তাঁহার দুর্নীতিপরায়ণ সরকারই ক্ষমতাসীন থাকুক। কিন্তু তালিবান কমান্ডারদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা চালাইতেছেন মার্কিন মধ্যস্থতাকারীরা। কারজাই-ও কিছু জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সমান্তরাল আলোচনার প্রক্রিয়ায় শামিল। ইহাদের অধিকাংশই প্রথাগতভাবে তালিবান-বিরোধী, এই সব কমান্ডারদের খেয়োখেয়িতে বীতশ্রদ্ধ হইয়াই তালিবানরা মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে বিশুদ্ধ শরিয়তি শাসন কায়েম করিতে আফগানিস্তানের দখল লইয়াছিল। কিন্তু হামিদ কারজাইয়ের সরকারের বিরুদ্ধে সুবিধাবাদী আঁতাত গড়িতে তাঁহারা একজোট। কারজাই ক্ষুব্ধ। আমেরিকার কাছে তাঁহার গুরুত্বহ্রাসে রীতিমত ক্রুদ্ধও। মার্কিন-বিরোধী নানা কথাবার্তাও বলিতেছেন, যদিও মার্কিন সেনার পাহারা ছাড়া কাবুলের বাহিরে দূরস্থান, ভিতরেও অবাধে চলাফেরা করার সামর্থ্য বা সাহস তাঁহার নাই। অন্য দিকে বিভিন্ন তালিবান গোষ্ঠী ক্রমশ ধৈর্য হারাইতেছে। দরকষাকষিতে নিজের দাবি তুলিয়া ধরার তাগিদ তো আছেই, উপরন্তু হেলমন্দ প্রদেশে আবাদ করা আফিমের চোরাচালান অব্যাহত রাখার তাড়নাও রহিয়াছে। ফারাহ্ প্রদেশ সেই চোরাচালানেরই কেন্দ্র, যাহার বিনিময়ে তালিবানের অস্ত্র কেনার তহবিল তৈয়ার হয়। হামিদ কারজাইয়ের সরকার তালিবানের সেই বাড়া ভাতে ছাই দিতেছে, অতএব হামলা চালাইয়া সরকারকে নিরস্ত করার চেষ্টা। আফগানিস্তানে এই চূড়ান্ত নৈরাজ্য ও হিংসার দাপট সেখানে কোনও স্থিতিশীল শান্তিকামী শাসনব্যবস্থা কায়েমে সহায়ক হইবে, এমন আশা কম। পরিস্থিতির এই বহুমাত্রিক জটিলতা জটিলতর হইবে পাকিস্তানের ভূমিকায়, যে দেশ সর্বদাই আফগানিস্তানকে নিজের খিড়কি-দরজা এবং ‘প্রভাবাধীন অঞ্চল’ বলিয়া গণ্য করিয়া আসিয়াছে। পাক দেওবন্দি মাদ্রাসাতেই তালিবানের জন্ম ও বিকাশের ইতিহাস তাহাকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে প্রভাব খাটাইবার নৈতিক অধিকারও দিয়াছে। আরও সমূহ রক্তক্ষয় আফগান অনিশ্চয়তা ও অরাজকতার সঙ্গী হইবে। |