দুটি ছেলের মৃত্যু এমন কী অস্বাভাবিক ব্যাপার? পশ্চিমবাংলায় আর মানুষ খুন হচ্ছে না? না, এই উক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নহে। এই উক্তি সাম্প্রতিকও নয়। ১৯৮৪ সালের ২৩ অগস্ট সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়াইয়া এই কথাটি বলিয়াছিলেন এক প্রসিদ্ধ বাঙালি আইনজীবী। তিনি একই সঙ্গে সি পি আই এমের প্রবীণ নেতাও। তাঁহার নাম সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও তীর্থকর দাশশর্মা নামক দুই তরুণের অস্বাভাবিক মৃত্যু সংক্রান্ত মামলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে সওয়াল করিতে গিয়া সে দিন সোমনাথবাবুর এই প্রশ্ন। সেই ধারা সমানে চলিতেছে। আই পি এল হইতে মান্না দে তাঁহার অলৌকিক সফরের অবকাশে সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে এবং বিনা কারণে সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যুকে ‘তুচ্ছ ঘটনা’ বলিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আলোড়ন তুলিয়াছেন, তাহা এই ইতিহাসের পদাঙ্কই অনুসরণ করিতেছে। ১৯৮৪ সালে তিনি যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্বাচনে হারাইয়াছিলেন, তাঁহার ভয়ানক উক্তির উত্তরাধিকার মমতাদেবী বহন করিতেছেন, ইতিহাসের পরিহাস বটে। অথচ, দুই কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে সোমনাথবাবুর অসংবেদী মন্তব্যটি তাঁহাকে কোন বিপাকে ফেলিয়াছিল, তাহা অন্তত মুখ্যমন্ত্রীর না জানিবার কথা নহে। মঙ্গলবারের ঘটনাটি সম্পর্কে ‘দুঃখজনক ঘটনা, তদন্ত চলিতেছে’র অতিরিক্ত কোনও মন্তব্যই তাঁহার করিবার প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু ‘সাজানো ঘটনা’র ভূত এক বার ভর করিলে নামায় কাহার সাধ্য।
তবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এক বার নয়, দুই বার নয়, বিভিন্ন উপলক্ষে ক্রমাগত তাঁহার বিভিন্ন অশোভন এবং অযাচিত মন্তব্যের দ্বারা আপন আসনকে এবং তত্সহ নিজের প্রশাসনকে হতমান করিয়া চলিয়াছেন, এমন দৃষ্টান্ত ভূভারতে বিরল। কিন্তু তিনি একা নহেন। বিরোধী বামপন্থীরাও প্রতিবাদী রাজনীতির নামে সেই পুরাতন অচলাবস্থার রাজনীতিতেই মগ্ন। দলীয় কর্মীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করিয়া বৃহস্পতিবার শহরে তাঁহাদের যে মূর্তি দেখা গেল, তাহা সেই একই কানাগলির রাজনীতির প্রতিমা, যাহা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাঁহাদের সৌজন্যে গত ছয় দশক ধরিয়া দেখিয়া আসিতেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ও সমাজ যাহার চরম মাসুল গনিয়া আসিয়াছে, আজও গনিতেছে।
অথচ পশ্চিমবঙ্গে শাসক এবং বিরোধী, উভয় পক্ষেরই ভাবিবার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রহিয়াছে। রাজ্যের কৃষি, শিল্প, পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কোনওটির হালই ভাল নয় এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সেই হাল ক্রমশ খারাপ হইতেছে। প্রতিটি বিষয়ে উন্নতির উপায় সম্পর্কে বিভিন্ন মত থাকিতে পারে। কিন্তু সেই সকল মত ও পথ লইয়া তর্ক কোথায়? চিন্তাভাবনা কোথায়? শাসক দল তথা তাহার অদ্বিতীয়া নেত্রীর জেদ রাখিতে গিয়া শিল্প-বিনিয়োগ শিকেয় উঠিয়াছে, অথচ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দল সেই বিষয়ে কোনও যথার্থ প্রতিবাদ গড়িয়া তুলিতে নারাজ। মা-মাটি-মানুষের সরকার মাটির উত্পাদনশীলতা বা কৃষিতে জলের ব্যবহার সম্পর্কে কী ভাবিতেছেন, কী ভাবে কৃষির সমস্যা সমাধান করিতে চাহেন, তাহার কোনও দিশা তাঁহাদের নিকট আজও মিলিল না, বিরোধীরাও সে জন্য দাবি জানাইলেন না। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কী করা দরকার, তাহা লইয়া কোনও রাজনৈতিক বিতর্ক নাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লইয়া রাজনৈতিক আন্দোলন বা বাদপ্রতিবাদ সকলই ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাতনী রাজনীতিকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত হইতেছে, যে ‘ছাত্র রাজনীতি’ বস্তুটিই শিক্ষার উন্নতির পথে এক বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এমনকী এই বস্তুটি আদৌ কেন থাকিবে, তাহা লইয়াও কোনও যথার্থ যুক্তিনির্ভর বিতর্ক নাই, যাহা আছে তাহার নাম গ্রাম্য তরজা। এবং কেবল রাজনৈতিক দল বা নেতা নহেন, সমাজের অমিতবাক বিদ্বজ্জনেরাও রাজ্যের প্রকৃত এবং গভীর সমস্যাগুলি লইয়া আলোচনায় নিস্পৃহ, তাঁহারাও আসর জমাইতে ব্যস্ত এবং ব্যগ্র। একটি রাজ্য বিভিন্ন মাপকাঠিতে ক্রমাগত পিছন দিকে অগ্রসর হইতেছে, অথচ তাহার ‘রাজনীতিসচেতন’ সমাজ ওই তরজায় গভীর হইতে আরও গভীরে নিমজ্জিত হইতেছে। এই অধোগমনের বোধ অবশ্য বাঙালি বহু পূর্বেই ত্যাগ করিয়াছে। সুতরাং অরণ্যে রোদনই সার। |