চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
চারপাশে লোভ ও ভোগের ইচ্ছা কিন্তু নেই পরিতৃপ্তি
সিমা গ্যালারিতে চলছে সুমিত্র বসাকের একক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ফাক্সনামা’। ‘ফাক্স’ কথাটির মধ্যে একাধিক স্তরের অর্থের দ্যোতনা আছে। প্রথমটি বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত। পুরুষের অন্তর্বাস প্রস্তুতকারী একটি সংস্থা তাঁদের তৈরি অন্তর্বাসে যে নাম ব্যবহার করে, তার সঙ্গে ধ্বনিগত মিল রেখে এই শব্দটি তৈরি করেছেন শিল্পী। এই শব্দটির মধ্যে দিয়ে এখনকার জীবনযাপনের প্রচারমুখী একটি ধরনকে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। দ্বিতীয় দ্যোতনা যৌনতা-সংক্রান্ত। তৃতীয়ত, এর মধ্য দিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে অপরিশীলিত কৌতুকের আভাস। আজকের বাস্তবতায় গ্রামের মধ্যে শহর ঢুকে যাচ্ছে। শহরের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করছে গ্রাম্যতা। এই সম্মিলনকে আরও জাঁকালো করছে আজকের বিশ্বায়িত বাজার। মুনাফার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়া যার অন্য কোনও নৈতিকতা নেই। জীবনের এই যে কলরোল চলছে চারপাশে তার মধ্যে তীব্র লোভ ও ভোগস্পৃহা আছে, কিন্তু কোনও পরিতৃপ্তি বা লক্ষ্য নেই। এই নৈরাজ্যকে শিল্পী কশাঘাত করতে চেয়েছেন তাঁর ২৫টি ছবিতে কৌতুকের ভাষায়।
সুমিত্র ১৯৯৯তে বিশ্বভারতীর কলাভবন থেকে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর পাঠক্রম শেষ করেছেন। তার পর থেকে যে আঙ্গিক নিয়ে তিনি চর্চা করছেন, তার মধ্যে লৌকিক ও নাগরিক রূপবোধের সম্মিলন আছে। দৃশ্যকলার পরিভাষায় তাকে ‘পপ-আর্ট’ বলা যায়। ‘পপ’ কথাটি ‘পপুলার’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
শিল্পী: সুমিত্র বসাক
নিম্নকোটির জনসাধারণের সংস্কৃতি যে দৃশ্য উপাদান তৈরি করে তাকে ব্যবহার করে আধুনিকতাবাদী এক শিল্পভাষা উদ্ভাবনের প্রয়াস পাশ্চাত্যে চলছে ১৯৬০-এর দশক থেকে। বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদী রূপরীতির অতিরিক্ত পরিশীলনের প্রতিক্রিয়ায় এসেছিল পপ-আর্টের আন্দোলন। আমেরিকায় অ্যান্ডি ওয়ারহোল, রয় লিচটেনস্টেইন, জাসপার জোনস প্রমুখ শিল্পীর কাজের মধ্যে বিজ্ঞাপন, কার্টুন ইত্যাদি উপাদান মিশে গিয়ে করুণাদীর্ণ এক কৌতুকের আবহ সৃষ্টি করত। আমাদের ১৯৬০-এর দশকের শিল্পী ভূপেন খক্করের ছবিতেও অপরিশীলিত ‘পপুলার’-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ প্রসঙ্গে গগনেন্দ্রনাথের কার্টুনধর্মী কৌতুকনকশামূলক ছবির কথাও মনে আসে।
সুমিত্র এই পরম্পরাকে সাম্প্রতিকে প্রসারিত করেছেন, যদিও অ্যান্ডি ওয়ারহোল বা ভূপেন খক্কর কারওরই কোনও প্রভাব তাঁর মধ্যে নেই। তিনি বাংলার লৌকিক সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করে তা থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করেছেন। সেগুলি আজকের নাগরিক সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ করে কেমন বিকৃত, অনেক সময় অশালীন এবং কৌতুককর হয়ে উঠছে তার বিশ্লেষণ করেছেন। সব চেয়ে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন কেমন করে জীবনকে গ্রাস করছে, প্রায় সব ছবিতেই এটা তিনি দেখিয়েছেন। এই উপস্থাপনায় তিনি কাজে লাগিয়েছেন দ্বিমাত্রিক কৌতুকধর্মী কার্টুনের ভাষা। বাস্তবতা ও কল্পরূপকে একসঙ্গে মিলিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কৌতুকদীপ্ত কল্পরূপের ভিতরে জীবনের অন্তঃসারশূন্যতার করুণ ট্র্যাজেডির ইতিবৃত্তকে আভাসিত করেছেন।
প্রথম ছবির শিরোনাম ‘পাল্টি খাচ্ছি’। ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিকের রচনা। দ্বিমাত্রিক ভাবে আঁকা লোহিতবর্ণ একটি মানুষ উল্টে যাচ্ছে। তাঁর শরীর জুড়ে ফুলের অলঙ্করণ আছে। এই পাল্টি খাওয়াটা এ যুগের রাজনীতি ও জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দ্বিতীয় ছবি ‘আমার সোনার বাংলা’। বাংলার বুকের উপর সূর্য উঠছে। সমগ্র বাংলা ছেয়ে আছে ‘ফাক্স’-এর বিজ্ঞাপনে। গরু-বাছুর দাঁড়িয়ে আছে। খোলা মাঠে মানুষ প্রাতঃকৃত্য সারছে। রেলপথ ও জলপথ ঘিরে আছে সমগ্র প্রদেশকে। সর্বত্রই শুধু ‘ফাক্স’ আর ‘ফাক্স’। ‘ব্রিজ টু হেভেন’ বা ‘স্বর্গের সিঁড়ি’ ছবিতে নদীর উপর দিয়ে চলে গেছে বিপুল ফ্লাই-ওভার। তার উপর দিয়ে কাঁধে বাঁক নিয়ে চলেছে এক জন মুটে। বাঁকের দু’প্রান্তেই রয়েছে বিপুলকায় ফাক্স-এর প্যাকেট। ‘ফাক্স অফ’ ছবিতে দেখা যাচ্ছে পুরুষের নারীসম্ভোগ ও মূত্র-ত্যাগ যেন একই প্রক্রিয়া। ‘ফাক্সপুর দহন’-এ লাল হনুমান শূন্যে ভেসে শহর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সমস্ত দেশ যেন বিজ্ঞাপন আর যৌনতার আখড়া। এই দুইয়ের দাবদাহে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়া এর অন্য কোনও সম্ভাবনা নেই। তবু ‘পক্ষীরূপী ধর্ম’ আসে। শূন্যপানে চেয়ে থাকে। এই পাপ নিরাকরণের কোনও উপায় কি তার জানা আছে? ফাক্স-এর দাপটে আজকের অসহায় মানুষ এর উত্তর জানে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.