|
|
|
|
আসছে নয়া আইন... |
ভুঁইফোঁড় আর্থিক
সংস্থায় রাজ্যের রাশ
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
|
|
পশ্চিমবঙ্গে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির দৌরাত্ম্য রুখতে এ বার কঠোর আইন করতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আগামী বিধানসভা অধিবেশনে এ ব্যাপারে একটি নতুন বিল পেশ করবে রাজ্যের অর্থ দফতর। এক প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আগের সরকার এ ব্যাপারে একটি বিল পেশ করে রাষ্ট্রপতির সম্মতি আদায়ের জন্য পাঠিয়েছিল। গত আট বছরেও বিলটি রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ফেরত আসেনি। আমরা সেটি রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ফেরত চেয়েছিলাম। বিলটি ফেরত এসে গিয়েছে।” এ বার যে বিলটিকে আরও কঠোর করা হবে, সে কথা স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “আরও কঠোর বিল তৈরি করে বিধানসভায় পেশ করা হবে।” এ নিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গেও মুখ্যমন্ত্রী এ নিয়ে কথা বলেছেন। কেন্দ্রকে এ ব্যাপারে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাজ্য সরকার। মমতা বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে শুধু সংবাদমাধ্যমই নয়, আরও নানা ধরনের পেশাগত দিকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এই সংস্থাগুলি। বহু সামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গেও এগুলি যুক্ত। তাই বিষয়টি সংবেদনশীল। কেন না, রাজ্যের বহু ছেলেমেয়ে এই সব সংস্থায় চাকরি করে। বিনা দোষে তাদের চাকরি চলে যাবে, এটা কখনওই কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হতে পারে না।” কিন্তু এই যুক্তিতে যে বেআইনি কাজ করার অধিকার জন্মায় না, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “দেশের আইন আছে। কোনও সংস্থা ভারতীয় দণ্ডবিধির তোয়াক্কা না করে অন্যায় কাজ করবে এবং রাজ্যে একটা সমান্তরাল অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা হবে, সেটাকে আমি কখনওই সমর্থন করি না। সে জন্যই কঠোর আইন প্রয়োগ করে এদের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।”
বামফ্রন্টের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গে বহু ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থা গড়ে ওঠে। দ্রুত সেগুলির দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছিল। রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত এই ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অভিযানও শুরু করেছিলেন। কিন্তু তখন আলিমুদ্দিনের কিছু নেতার সঙ্গে এই অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কর্তাদের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় বলে অভিযোগ। তখন যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল তৎকালীন সরকার। ‘চিট ফান্ড হটাও’ অভিযান কেন থমকে গেল তখন সেই প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছিল অসীমবাবুকে। তৎকালীন বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, বামফ্রন্ট সরকারের সহায়তাতেই ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলি আবার কাজ শুরু করে দেয়।
পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২৩টি। প্রণব মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকার সময় সেবি-র নেতৃত্বে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। সে সময় অনেক সংস্থার কর্ণধার প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, সংবাদমাধ্যম বা হাসপাতাল খুলে সংস্থাগুলি মানবদরদী সাজার চেষ্টা করলেও তারা যে গরিব মানুষের কাছ থেকেই সব থেকে বেশি টাকা তুলেছে, সেই সত্যিটা তো বদলে যায় না! সেই টাকা ফেরত দেওয়ার দায় তাই সংশ্লিষ্ট সংস্থারই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, হয় তা ঠিক ভাবে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না, অথবা সংস্থাগুলিই বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাই ভারত সরকারও বিষয়টি নিয়ে কঠোর মনোভাব নিয়েছে। সম্প্রতি সহারা-র টাকা তোলা নিয়ে বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
কী থাকবে রাজ্যের নতুন আইনে? অর্থ দফতরের কর্তারা জানান, এখন টাকা তোলা সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লে তবেই পুলিশ তদন্ত করতে পারে। সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করার ক্ষমতা রাজ্যের হাতে নেই। সেই ক্ষমতা চেয়েই ২০০৩ সালে বিধানসভায় বিলটি পাশ হয়। ২০০৫ সাল থেকে সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে পড়ে ছিল। প্রস্তাবিত আইনে ‘মানি মাকের্টিং’-এর নামে যারা টাকা তুলছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বারবার টাকা তোলা সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে একত্রিত করে ব্যবস্থাগ্রহণের পন্থা ঠিক করতেও বলেছে তারা।
সেই পরামর্শ মেনে চার দফা পদক্ষেপের কথা ভাবা হয়েছে বলে কর্তারা জানান।
এক, আইন পাশ।
দুই, অর্থ দফতরের আর্থিক অপরাধ দমন শাখাকে আরও মজবুত করা।
তিন, এফএম রেডিও, বাংলা খবরের কাগজে লাগাতার প্রচার।
চার, স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের জন্য সচেতনতা বাড়ানো।
শুধুই কি কেন্দ্রের চাপে এই ব্যবস্থা, নাকি রাজ্যও সংস্থাগুলির দৌলতে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? অর্থ দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, সংস্থাগুলি বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে রাজ্যের অর্থ সঙ্কট আরও বাড়িয়েছে। বেশি সুদ পাওয়ার আশায় সাধারণ মানুষ রাজ্য সরকারের স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে টাকা ঢালার বদলে ওই সংস্থাগুলিতে লগ্নি করছে। ফলে ২০১২-১৩ সালে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প থেকে কোনও আয়ই করতে পারেনি রাজ্য। ২০১০-১১ সালে এই খাতে সরকার ১২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা পেয়েছিল। ২০১১-১২ সালে ৩ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার আশা করে পেয়েছিল ১৬৫৮ কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত আর্থিক বছরে বাজেটে তিন হাজার কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিলেও আদতে হাতে কিছুই আসেনি।
শুধুই কি সরকারের সঞ্চয় প্রকল্প মার খাচ্ছে বলে এই ব্যবস্থা? নাকি সংস্থাগুলি বেআইনি কাজও করছে?
অর্থ দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, মূলত পাঁচ ভাবে কোনও সংস্থা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলতে পারে। সেগুলি হল এক, কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে। দুই, মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে। তিন, পাবলিক ডিবেঞ্চার বিক্রি করে। চার, নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি ও চিট ফান্ড তৈরি করে। এবং পাঁচ, কোম্পানিতে লগ্নি চেয়ে বা কোম্পানি ডিপোজিট সংগ্রহ করে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই তহবিল সংগ্রহের নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির কাজ সেবি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের। শুধু কোম্পানি ডিপোজিট সংগ্রহ করলে, তা নিয়ন্ত্রণ করে রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ (আরওসি)।
আর্থিক দফতরের কর্তাদের বক্তব্য: আইন বলছে, কোনও কোম্পানি তার মূলধনের ২৫ শতাংশ টাকা কোম্পানি ডিপোজিট হিসেবে বাজার থেকে তুলতে পারে। তার বেশি তোলা বেআইনি। এ রাজ্যে ‘গ্রুপ অফ কোম্পানিজ’-এর নামে অজস্র কোম্প এ ছাড়াও ডিবেঞ্চার বিক্রির নামে যথেচ্ছ বেনিয়ম হচ্ছে। যদি কোনও সংস্থা ৫০ জন লগ্নিকারীকে ডিবেঞ্চার বিক্রি করে, তা সেবি-র নিয়ন্ত্রণে আসে না। তার চেয়ে বেশি হলেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে শেয়ার বাজারে নাম লেখাতে হয় এবং সমস্ত তথ্য জনগণের সামনে আনতে হয়। এ রাজ্যে সেবি-র নজরদারি এড়াতে একই মালিক বহু সংস্থার নামে ডিবেঞ্চার বিক্রি করছে। হিসেব বর্হিভূত ডিবেঞ্চার বিক্রি করছে। নতুন আইনে এই ধরনের বেনিয়ম হলেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হবে। যা বাম আমলে তৈরি হওয়া আইনে ছিল না।
|
চার পদক্ষেপ |
|
• আইন পাশ
• আর্থিক অপরাধ দমন শাখাকে মজবুত করা
• বিভিন্ন মাধ্যমে লাগাতার প্রচার
• স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের জন্য সচেতনতা বাড়ানো
|
কী থাকছে আইনে |
|
• ‘মানি মাকের্টিং’-এর নামে যারা টাকা তুলছে, তাদের বিরুদ্ধে
স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে বিশেষ ক্ষমতা |
|
|
পুরনো খবর: ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থার বিরুদ্ধে নামছে রাজ্যও |
|
|
|
|
|