বাইশ বছরের শত্রুঘ্ন চৌধুরী হুগলির গোন্দলপাড়া পাটকলের ‘বিন’ বিভাগের শ্রমিক ছিলেন। ২৪ অগস্ট গভীর রাতে মেশিনে একটা কেব্ল ঢুকে যায়। সেটা সরাতে গিয়ে মেশিনে ঢুকে যায় শত্রুঘ্নের শরীরটাও। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তার। পশ্চিমবঙ্গের পাটকলগুলিতে এমন দুর্ঘটনা নিত্য দিনের। প্রতি বারই দুর্ঘটনার পরে কয়েক দিন বা কয়েক ঘণ্টার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকেরা। তার পরে ইউনিয়ন, কারখানা কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনায় ঠিক হয়ে যায় ক্ষতিপূরণের অঙ্ক। কিন্তু দিন পাল্টায় না। দুর্ঘটনা আর মৃত্যু হয়েই চলে।
নর্থ ব্রুক, অ্যাঙ্গাস, ডালহৌসি, গোন্দলপাড়া, তেলিনিপাড়া পাট কলের বেশির ভাগ শ্রমিকেরই এক মাত্র ভরসা গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতাল। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ভর্তি হন অস্ত্রোপচার বিভাগে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, শুধু মাত্র মার্চ মাসেই অস্ত্রোপচারের কেস নথিভুক্ত হয়েছে ২১৫টি। যার মধ্যে ৮০ টিই যান্ত্রিক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত। হাসপাতালের রেকর্ড বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আজিজ আহমেদ বলেন, “প্রায়শই মেশিনে হাত কেটে যাওয়া, আঙুল কেটে যাওয়া, হাতের তালু বা পা ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। সেই হিসেবে গড়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই প্রতিটা মিল থেকে ৪টি করে এই রকম ঘটনা পাওয়া যাবে।”
গৌরহাটি ইএসআই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন নর্থ ব্রুক চটকলের শ্রমিক মহম্মদ সাপরুদ্দিন। তিনি বলেন, “এক মাস আগে মেশিনে চোট লেগেছিল কোমরে। এখনও ব্যথা হয়। প্রায় এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে বসে রয়েছি।” |
শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, শ্রমিকদের মধ্যে যন্ত্রঘটিত দুর্ঘটনার হার সব চেয়ে বেশি। কেবল শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালেই দিনে চার থেকে পাঁচ জন কারখানার ভিতরে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চিকিৎসা করাতে আসেন। মানিকতলা ইএসআই, যেখানে পাট কলের শ্রমিকরা আসেন আরও বেশি সংখ্যায়, সেখানে এই সংখ্যাটা দিনে ১০ থেকে ১৫। আর হুগলি-হাওড়া, যেখানে চটকলগুলির সংখ্যাধিক্য বেশি, সেখানে ইএসআই হাসপাতালগুলিতে এই সংখ্যাটা আরও বেশি।
প্রায় প্রতিদিনই এরকম দুর্ঘটনার কারণ কী? ওই চিকিৎসক বলেন, “পাটকলগুলিতে দিনে আট ঘণ্টার উপর এক টানা দাঁড়িয়ে কাজ করেন শ্রমিকেরা। সেক্ষেত্রে একটু বিশ্রাম না থাকলে কোনও সময়ে শ্রমিকদের মুহূর্তের ভুল হতেই পারে। সব সময়েই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়।” তিনি আরও জানান, যন্ত্র থেকে শ্রমিকদের একটি নির্দিষ্ট নিরাপদ দূরত্ব থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই তা মানা হয় না।
গোন্দলপাড়ার শ্রমিক সঞ্জয় রাজবংশী যেমন জানালেন, “আমরা এক একটা মেশিনে চার জন করে কাজ করি। যেখানে মেশিনের সঙ্গে ৪ ফুট করে দূরত্ব থাকার কথা, সেখানে আমরা আড়াই ফুটেরও জায়গা থাকে না। আর ঘাম মোছার জন্য কোমরে একটা গামছা তো রাখাই থাকে। অনেক সময়ে সেটা পিছলে গিয়েও দুর্ঘটনা ঘটে।”
এআইটিইউসির নেতা দেবাশিস দত্তের অভিযোগ, “চটকলগুলিতে একেবারেই যন্ত্রপাতির দেখভাল করা হয় না। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মেশিন বন্ধ রাখার কথা। কিন্তু তা হয় না। তাতে যে কোনও দুর্ঘটনা বা আগুন লাগার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ। কিছু কিছু মেশিনের সামনে ও পিছনে চার জন করে শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য কোনও ব্যবস্থাই নেই মিলগুলিতে। ঠিকঠাক মিল পরিদর্শনও করা হয় না।”
ইএসআই হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, দুর্ঘটনার পাশাপাশি প্রতি দিন অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন করতেই হয় শ্রমিকদের। কখনও কখনও ১০০ থেকে ১৫০ কিলোগ্রাম ওজনের পণ্য মাত্র দু’জন হাত লাগিয়ে তোলে বা নামায়। ফলে পিঠে ব্যথা এখানকার একটা নিত্য সমস্যা। এর জেরে ৩০ শতাংশ শ্রমিক অকালে কর্মক্ষমতা হারায়। তাদের ছুটি নিয়ে বসে থাকতে হয়।
এই ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকাতে কী কী ব্যবস্থা রয়েছে পাটকলগুলিতে? প্রশাসনিক সূত্রে খবর, যান্ত্রিক কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে গত বছরেই শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু কিছু কিছু কারখানা পরিদর্শনের জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু তা কোনও কারণে তা আর কার্যকরী হয়নি। আবার, অনেক দিন ধরে বহু কারখানায় বা চটকলে কোনও আধুনিকীকরণ হয়নি। ফলে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।
শ্রম দফতরের এক কর্তা বলেন, এই বিষয়গুলি তাদের আওতাধীন নয়। দেখার কথা মিল পরিদর্শকের। ইন্ডিয়ান জুটমিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তরফে মণীশ পোদ্দারের বক্তব্য, মিল পরিদর্শন নিয়মিত হচ্ছে। চটকলগুলিতে কাজের পরিবেশ উন্নত হচ্ছে। যন্ত্রঘটিত দুর্ঘটনার হারও অনেক কমছে। তাঁর দাবি, “খাতায়-কলমে নথিভুক্ত দুর্ঘটনার হার বাড়লেও, প্রকৃতপক্ষে তা খুবই কম।” |