আইনি লড়াইয়ের মধ্যেই বৃহস্পতিবার বিকেলে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নতুন নির্ঘণ্টের প্রস্তাব দিল রাজ্য সরকার।
হাইকোর্টে এ দিন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় জানান, আগামী ৫ ও ৮ মে পঞ্চায়েত ভোট করতে চায় রাজ্য। এই নতুন প্রস্তাব নিয়ে আদালতের বাইরে নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য, দু’পক্ষকে আলোচনায় বসতে বলেছেন বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, কে কী সিদ্ধান্ত নিল, সেটা যেন আগামী মঙ্গলবার কোর্টে এসে দু’পক্ষই জানান।
আদালতের বাইরে মিটমাটের এই প্রচেষ্টায় কি আদৌ ফল মিলবে? এ দিন কিন্তু রাজ্য সরকার বা রাজ্য নির্বাচন কমিশন, কোনও তরফেই এমন কোনও ইঙ্গিত মেলেনি। দু’পক্ষই জানিয়েছে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে কমিশন ও রাজ্যের মূল মতভেদ, সেই কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগের প্রশ্নটি অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে। এ দিনের শুনানিতে রাজ্য যা ইঙ্গিত দিয়েছে, তাতে, রাজ্যের সশস্ত্র পুলিশ এবং ভিন রাজ্যের পুলিশ দিয়েই তারা ভোট করাতে চায়। অন্য দিকে, কমিশন অনড় ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিতেই।
বস্তুত, এ দিন কমিশনের আইনজীবী সমরাদিত্য পালের সওয়ালের বেশির ভাগটাই ছিল পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। তিনি আদালতকে জানান, রাজ্যের বিভিন্ন জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে, দফায় দফায় জেলাশাসক ও রাজ্য পুলিশের বড় কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই কমিশন এই পরিমাণ কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ওই আলোচনা থেকেই কমিশন বুঝতে পেরেছে, আধাসামরিক বাহিনী ছাড়া ভোট করা সম্ভব নয়।
এ দিন নতুন নির্ঘণ্টের কথা জানানোর সময় কিন্তু সেই প্রসঙ্গে কোনও প্রতিশ্রুতিই দেননি অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমলবাবু। শুনানির একেবারে শেষ লগ্নে এসে তিনি নতুন নির্ঘণ্টের কথা জানান। সেই ঘোষণার পরে তিনি এজলাসে বলেন, “অবাধ ও মুক্ত ভোট করানোর জন্য নির্বাচন কমিশনের যা যা প্রয়োজন, রাজ্য সরকার সব ব্যবস্থা করবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।” তাঁর এই বক্তব্য কিন্তু সন্তুষ্ট করতে পারেনি সমরাদিত্যবাবুকে। তিনি জানতে চান, “নিরাপত্তাবাহিনী কি আপনারা তৈরি করবেন? পাবেন কোথায়?” অ্যাডভোকেট জেনারেলের উত্তর, “রাজ্য সরকারের উপরে আস্থা রাখুন। দেখবেন সব ঠিক হবে।” সমরাদিত্যবাবু বলেন, “আস্থা দেখানোর জায়গা বিধানসভা। হাইকোর্ট নয়।” বিমলবাবু তখন বলেন, “যথাসময়ে ভোট করাটা দরকার। কমিশন, রাজ্য সরকার দু’জনেই চিন্তিত। আসুন নির্বাচনটা সম্পন্ন করা যাক।” সমরাদিত্যবাবু পাল্টা বলেন, “দু’চারটে চিঠি লিখে একটা নির্বাচন করা যায় না।” অ্যাডভোকেট জেনারেল এ বার মন্তব্য করেন, সাধারণ নির্বাচন এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনকে এক করে দেখবেন না। দু’টি নির্বাচনের চরিত্র আলাদা।
এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেন বিচারপতি সমাদ্দার। তিনি বলেন, “লোকসভা হোক, বিধানসভা হোক, পঞ্চায়েত হোক, ভোট তো দেয় একই মানুষ। আপনারা এই সপ্তাহের শেষে বসুন। নিজেদের মধ্যে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে মঙ্গলবার জানান।”
আদালত আলোচনা করতে বলেছে। কিন্তু রাজ্যের এই নতুন প্রস্তাব নিয়ে একাধিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথমত, মামলা চলাকালীন রাজ্য এমন প্রস্তাব দিতে পারে কি? জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মামলায় সংবিধানের বিভিন্ন ধারা নিয়ে আলোচনা চলছে। কমিশন বিজ্ঞপ্তি জারির উপরে স্থগিতাদেশও চায়নি। তাই নীতিগত ভাবে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে কোনও ভুল নেই।”
দ্বিতীয় প্রশ্ন, আচমকা কেন এই বিজ্ঞপ্তি জারি করল রাজ্য? সরকারের তরফে বলা হয়েছে, তারা যে ভোট করাতে উৎসাহী, সেটা বোঝাতেই এই ঘোষণা। তৃণমূলের তরফেও বারবার এই কথাই বলা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার তারা যে পথে নেমেছিল, সেটাও নির্বাচনের বিরুদ্ধে দীর্ঘসূত্রী হওয়ার অভিযোগ তুলেই। পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়, দু’জনেই বলেছেন, “ঠিক সময়ে ভোট করানো নিয়ে রাজ্য সরকারের যে সদিচ্ছা রয়েছে সেটাই আমরা প্রমাণ করলাম।” আদালতের বাইরে এ দিন অশোকবাবুও বলেন, “লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কমিশন এটা বিবেচনা করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করুক। রাজ্য সরকার সময় নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইতিমধ্যেই গরম পড়ে গিয়েছে। মানুষ কষ্ট পাক, সেটা মুখ্যমন্ত্রী চান না।” আইনজীবী মহলের বক্তব্য অবশ্য অন্য। কমিশনের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে রাজ্য আসলে পঞ্চায়েত ভোট পিছিয়ে দিয়ে প্রশাসক বসাতে চাইছে বলে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সেই ধারণা যে ভুল, তার প্রমাণ দিতেই রাজ্য এ দিন নতুন দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
তৃতীয় প্রশ্ন: রাজ্য যে নতুন দিন ঘোষণা করেছে, তাতে কি ভোট করানো সম্ভব?
কমিশন সূত্র বলছে, পঞ্চায়েত ভোট করাতে বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে ন্যূনতম ২৮ দিন প্রয়োজন হয়। অথচ মঙ্গলবারের আগে কমিশনের পক্ষে বিজ্ঞপ্তি জারি করা সম্ভব নয়। কারণ, দু’পক্ষ যদি আলোচনা করে সহমতে পৌঁছয়ও, তা হলেও হাইকোর্টের সামনে সে কথা জানানোর আগে কমিশন কী ভাবে বিজ্ঞপ্তি জারি করবে? সে ক্ষেত্রে খুব তাড়াতাড়ি হলেও পরবর্তী শুনানি অর্থাৎ ৯ তারিখের আগে বিজ্ঞপ্তি জারি করা যাবে না। তা হলে আর ৫ তারিখের ভোটের আগে ন্যূনতম ২৮ দিন মিলবে না। কমিশন সূত্রের মন্তব্য, রাজ্য সরকার জেনেশুনেই নতুন দিন ঠিক করেছে। মামলাকে কিছুটা বিলম্বিত করাই এর উদ্দেশ্য বলেও মনে করছেন অনেকে।
সর্বোপরি প্রশ্ন, আদালতের নির্দেশ মেনে কি দু’পক্ষ আলোচনায় বসবে? কমিশনের আর এক আইনজীবী লক্ষ্মীচাঁদ বিহানী জানান, “রাজ্যের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। তবে এক ঝলকে রাজ্যের চিঠির যে বয়ান আমরা দেখেছি, তাতে আমরা যে সব বিষয়ে বারবার গুরুত্ব দিয়েছি (নিরাপত্তা) তার কোনও পরিষ্কার জবাব পাইনি।” রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব তাপস রায় আদালতের বাইরে বলেন, “রাজ্য সরকারের এই চিঠির বিষয়টি সবে জানতে পারলাম। আমরা নিজেদের মধ্যে আগে আলোচনা করব।”
এর আগে শুনানির বড় অংশ ধরেই কেন্দ্রীয় বাহিনী থেকে শুরু করে রাজ্যের সঙ্গে বিভিন্ন মতভেদ নিয়ে সওয়াল করেছেন সমরাদিত্যবাবু। সেখানে ওঠে ভোট পর্যবেক্ষকদের প্রসঙ্গও। সমরাদিত্যবাবু বলেন, পর্যবেক্ষক হিসেবে ৪০০ আইএএস, ডব্লিউবিসিএস অফিসার প্রয়োজন বলে কমিশন জানিয়েছিল। রাজ্য মাত্র ১৩৪ জনের তালিকা পাঠায়। পরে আবার ১৬৯ জনের তালিকা পাঠায়। দুই তালিকার বেশ কিছু নামই ছিল এক। এরই মধ্যে হঠাৎ ১৯ মার্চ ১৯ জন বিডিও এবং দু’জন এসডিও-কে বদলি করে দেওয়া হয়। এই নিয়ে কমিশনকে আগে থেকে কিছু জানানোও হয়নি। অ্যাডভোকেট জেনারেল এই সময় বলেন, “রাজ্য সরকারের এই বদলি করার এক্তিয়ার আছে। আইন মেনেই তারা যা করার করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারে।” সমরাদিত্যবাবুর জবাব, “সেটা ঠিকই। কিন্তু পুরসভা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ভার চলে যায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপরে।”
বিচারপতি সমাদ্দার জানতে চান, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে বাহিনী মোতায়েনের দায়িত্ব কার? সমরাদিত্যবাবু বলেন, সংবিধান ও আইন অনুযায়ী এই দায়িত্ব রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের। বিচারপতি জানতে চান, ভোটের আগে ও পরে নির্বাচনের ফল ঘোষণা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলার পুরো দায়িত্বই কি নির্বাচন কমিশনারের? সমরাদিত্যবাবু বলেন, “অবশ্যই।” বিচারপতি প্রশ্ন করেন, বাইরে থেকে বাহিনী আনার বিষয়টিও কি কমিশনই ঠিক করে? সমরাদিত্যবাবু বলেন, পুরো দায়িত্বই কমিশনের। অ্যাডভোকেট জেনারেল বিচারপতি সমাদ্দার এবং সমরাদিত্যবাবুকে দু’টি চিঠি দিয়ে বলেন, “ রাজ্য সরকার আবার দিন ঠিক করেছে। নির্ধারিত সময়ে ভোট করাই এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত।” ফের শুনানি হবে মঙ্গলবার। |