‘তুচ্ছ’ ঘটনা বলে বিতর্ক বাড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী
সএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যু নিয়ে বেঙ্গালুরুতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য নতুন বিতর্ক উস্কে দিল। সুদীপ্তর মৃত্যুকে আগেই দুর্ভাগ্যজনক বলে আখ্যা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবারও বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যা হয়েছে, তা দুভার্গ্যজনক। কিন্তু এটা একটা দুর্ঘটনা। ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই স্পষ্ট যে, পুলিশি অত্যাচার হয়নি।” এর পর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের যে দাবি বিরোধীরা তুলেছেন, তা কি সরকার মেনে নেব? তার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ইট্স আ স্মল ম্যাটার, পেটি ম্যাটার (ছোট ঘটনা, তুচ্ছ ঘটনা)।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের জেরেই সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে। মন্তব্যের নিন্দা করেছেন, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র থেকে শুরু করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। বিরোধীদের অভিযোগ, পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণ হোক বা কলেজে শিক্ষক নিগ্রহ, সব কিছুকেই তুচ্ছ করে দেখানো অভ্যাসের পরিণত করে ফেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এক জন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুতেও সেই অভ্যাস থেকে মুক্ত হতে পারলেন না তিনি। বিমানবাবুর কথায়, “ওঁর এমন দুমদাম মন্তব্য করা চলবে না। কখন কোন বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করবেন, আর কোন বিষয়ে করবেন না, তা ওঁকে শিখতে হবে।” আর প্রদীপবাবুর মতে, মমতার মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক।
শুধু ‘তুচ্ছ ঘটনা’ সংক্রান্ত মন্তব্য নয়, তদন্ত চলার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে সুদীপ্তর মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলেছেন, তা নিয়েও সরব হয়েছেন বিরোধীরা। সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কখনও কোনও ঘটনার তদন্তের জন্য অপেক্ষা করেন না। সুদীপ্তের মৃত্যুর ক্ষেত্রেও তা-ই করে দিলেন। উনি এমন মন্তব্য করে দিলে তো তদন্তের কাজ আর এগোবেই না!” প্রদীপবাবুর মন্তব্য, “সেই পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড থেকে দেখে আসছি উনি (মমতা) পুলিশকে প্রভাবিত করছেন। দলীয় রাজনীতির স্বার্থে নিরপেক্ষ তদন্তে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন।”
ঘটনাচক্রে এ দিনই রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন সুদীপ্তর মৃত্যু প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কোনও মন্তব্য করব না। আগে তদন্ত শেষ হোক। অকারণ অনুমানে ইন্ধন দেওয়া কেন?” মমতা এই মৃত্যুকে ‘দুর্ঘটনা’ বলেই আখ্যা দিয়েছেন শুনে রাজ্যপালের জবাব, “আমার যা বলার আগেই বলে দিয়েছি।”
লালবাজারের কর্তাদেরও অবশ্য দাবি, সুদীপ্তর মৃত্যু দুর্ঘটনাই। ল্যাম্পপোস্টে মাথা ঠুকে এবং মাটিতে পড়েই তার মৃত্যু হয়েছে বলে ময়নাতদন্তে জানা গিয়েছে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম বলেন, “ময়নাতদন্তে সুদীপ্তের মৃত্যুর কারণ হিসেবে তাঁর মাথার পিছনে আঘাতের কথা বলা হয়েছে।” রিপোর্টটি এ দিনই জমা পড়েছে। কিন্তু ঘটনার রহস্যভেদে ময়নাতদন্তের রিপোর্টই সব নয় বলে এ দিন মেনে নিয়েছেন শামিম। তাঁর কথায়, “ময়নাতদন্ত সামগ্রিক তদন্তের একটি ছোট অংশ। সুদীপ্তের মর্মান্তিক মৃত্যু কী ভাবে হয়েছে, তা নিরপেক্ষ ভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিচ্ছি না।”
গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষকে পাশে নিয়ে শামিম জানান, কী ভাবে সুদীপ্তর মৃত্যু হয়েছে, তা বুঝতে ঘটনাক্রমের পুনর্গঠন করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরাও এ দিন তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেন। কিন্তু ওই জায়গাটি রক্ষণাবেক্ষণের বন্দোবস্ত নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। ফরেন্সিক তদন্তের সুফল পেতে কোনও ঘটনাস্থল, ‘সিল’ করে দেওয়াই সাধারণ দস্তুর। এ ক্ষেত্রে কিন্তু প্রেসিডেন্সি জেলের কাছে থ্যাকারে রোডে ৩৭ নম্বর ল্যাম্পপোস্টের সামনের ‘দুর্ঘটনাস্থল’টিতে আম-জনতার অবাধ যাতায়াত। যদিও গোয়েন্দাপ্রধানের দাবি, ঘটনাস্থলের উপরে পুলিশ সারা ক্ষণ নজর রাখছে। ওই ল্যাম্পপোস্টটিতেই সুদীপ্তের ধাক্কা লেগেছিল কি না, সেই বিষয়টি সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
পুলিশকর্তাদের অভিযোগ, কোনও কোনও মহল থেকে ঘটনার পরই পুলিশের লাঠিতে সুদীপ্ত মারা গিয়েছেন বলে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। শামিমের কথায়, “তদন্তের মাঝপথে এই ধরনের আলটপকা সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। পুলিশকে সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করতে হয়। উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই পুলিশের লাঠিতে সুদীপ্ত মারা গিয়েছে বলে দোষারোপে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।” তদন্তের এই পর্যায়ে মৃত্যুর কারণ নিয়ে আর একটু ভারসাম্য রেখে মন্তব্য করাই কাম্য বলেই শামিমের অভিমত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী নিজেই তো একে দুর্ঘটনা বলে দাবি করেছেন এবং যা তদন্তে প্রভাব খাটাতে পারে বলে অভিযোগ উঠছে! শামিম অবশ্য এই প্রশ্নের জবাব দেননি।
শামিম এ দিন বলেন, “মাথায় যে আঘাতের ফলে সুদীপ্তের মৃত্যু হয়েছে, তাতে কয়েকটি লক্ষণ স্পষ্ট। ক্ষত-চিহ্নে কোনও ভারী, ভোঁতা ও স্থির বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষ এবং তার পরে এবড়ো-খেবড়ো জমিতে পড়ার লক্ষণ রয়েছে।” অর্থাৎ ল্যাম্পপোস্টে মাথা ঠুকে মাটিতে পড়ার দিকেই তিনি ইঙ্গিত করেছেন। তাঁর দাবি, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বলছে, মাথার ওই অংশে লাঠির আঘাত নেই। লাঠির আঘাতে ‘মাল্টিপ্ল ফ্র্যাকচার’ হয় বা একাধিক জায়গায় চিড় ধরে। এ ক্ষেত্রে থেঁতলে গিয়েছে। হাড়ের জোড় খুলে গিয়েছে। যেটা সাধারণত লাঠিতে হয় না।
কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সুদীপ্তর কানের পাশে লাঠিজাতীয় কিছুর আঘাত রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তবে তা মৃত্যুর কারণ নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে। শামিম এ দিন বলেন, যে নেতা-কর্মীরা আইন অমান্য কর্মসূচিতে নামেন, তাঁরা কেউ অপরাধী নন। তাই গ্রেফতারের পরে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এই সময়ে পুলিশের হাতে লাঠি থাকার কথা নয়। শামিমের দাবি, “বাসে ৩০ জন তরুণ-তরুণী ও দু’জন পুলিশ ছিলেন। পুলিশের হাতে লাঠি ছিল না। তদন্তে এটাও স্পষ্ট হবে।”
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে আরও কয়েকটি দিক উঠে এসেছে। যেমন, সামনে থেকে কোনও ধরনের ধাক্কার কারণে অথবা বাসের গতির জেরে পড়ে গিয়ে ওই তরুণের মাথার পিছনে থেঁতলে গিয়েছে বলে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে। শামিমও জানিয়েছেন, এসএফআই নেতা-কর্মীদের যে বাসটিতে করে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তার চালকের বিরুদ্ধে বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। অর্থাৎ বাসের গতি বেশি থাকার কারণেও সুদীপ্ত পড়ে গিয়ে থাকতে পারেন। বাসচালক বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশকর্মীরা অবশ্য বলেছেন, বাস জোরে চলছিল না। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের তরফে এ দিন সুদীপ্তর মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.