নেতির রাজনীতি চলছেই, ভোগান্তি জনতার
নেতিবাচক দাবিতে একটা ঝুঁকিপূর্ণ আন্দোলন। তাতে একটি অপমৃত্যু। তার প্রতিবাদে আবার নেতিবাচক কর্মসূচি! নেতি আর নেতির এই দুর্বিপাকেই আটকে থাকল বঙ্গ রাজনীতি! শেষ পরিণামে ভোগান্তি হল সাধারণ মানুষের।
বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে দু’দিন আগে মৃত্যু হয়েছিল এসএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্তর। সেই ঘটনার প্রতিবাদে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে বৃহস্পতিবার সারা রাজ্য জুড়ে ১৫ মিনিটের পথ অবরোধ কর্মসূচি ছিল বাম যুব সংগঠনগুলির। টালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, গড়িয়ার মতো দক্ষিণ শহরতলিতে ১২ ঘণ্টার ধর্মঘট ছিল বামেদের। একই সঙ্গে এসএফআইয়ের ডাকে ছাত্র ধর্মঘট ছিল গোটা রাজ্যে। এই সব কর্মসূচির যোগফলেই এ দিন ভুগতে হয়েছে আমজনতাকে। অফিস টাইমের ব্যস্ত সময়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ জুড়ে শহরের ১৪টিরও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট অবরোধের জেরে ভণ্ডুল হয়ে যায় ট্র্যাফিক ব্যবস্থা। যা স্বাভাবিক হতে লেগে যায় দেড় ঘণ্টারও বেশি।
কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন কেন স্থগিত থাকবে, তার প্রতিবাদে মঙ্গলবার আইন অমান্যের ডাক দিয়েছিল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলি। যা নিয়ে ছাত্রদের পথে নামার কোনও কারণই নেই বলে শিক্ষা জগতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বদের অভিমত। তাঁদের মতে, গ্রন্থাগারে কেন ভাল বই নেই, ল্যাবরেটরির পরিকাঠামো কেন ঠিক নেই এ সব বিষয়ে ছাত্রদের আন্দোলন অনেক বেশি মানানসই। তার বদলে কলেজ প্রাঙ্গণে কেন তৃণমূল বা সিপিএমের ছাত্র সংগঠনকে খাতা খুলতে দেওয়া হচ্ছে না, এ নিয়ে রাস্তায় নেমে আইন অমান্য করে হাওয়া গরম করা অনর্থক!
সুদীপ্তর মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে ডিওয়াইএফআই-এর পথ অবরোধ। বৃহস্পতিবার মৌলালিতে।—নিজস্ব চিত্র
প্রচার পাওয়ার তাগিদে ঠিক সেটাই করতে গিয়েছিল বাম ছাত্র সংগঠনগুলি।
সেখানেই শেষ নয়। সেই হইচই বাধানোর কর্মসূচিতে একটি প্রাণহানির পরে শোক এবং প্রতিবাদের নামে এ দিন আবার জনজীবন অচল করতে চাওয়ারই বা কী যুক্তি প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষও। রাস্তায় স্তব্ধ যানবাহনে আটকে থেকে তাঁদের বিস্ময়, সরকারের কাছে দাবি আদায়ের জন্য সাধারণ জনতাকে পথে শাস্তি দেওয়ার যুক্তি কী? জনতার ভোগান্তির নানা ছবিই এ দিন ধরা পড়েছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। ধর্মঘটের জেরে গড়িয়া ও তার লাগোয়া যাদবপুর এবং সোনারপুরে অধিকাংশ দোকানপাট এবং বাজার বন্ধ ছিল। বন্ধ ছিল কলকাতা, হাওড়ার অধিকাংশ স্কুল-কলেজ। কলকাতা ট্রাফিক পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন সকাল ১১টা থেকে মিনিট পনেরোর জন্য পথ অবরোধ হবে বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে সর্বত্র একই সময়ে অবরোধ শুরু হয়নি। তার ফলে সমস্যা বাড়ে।
পুলিশ জানায়, উল্টোডাঙা-হাডকো মোড়, বেহালা চৌরাস্তা, বি কে পাল-চিৎপুর সংযোগস্থল, মৌলালি মোড়, শ্যামবাজার, গড়িয়া, হাজরা, তারাতলা এবং ই এম বাইপাসের পঞ্চান্নগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বেলা পৌনে ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এসএফআই কর্মী-সমর্থকেরা অবরোধ করেন। তার জেরে বি টি রোড, সিআইটি রোড, ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ, বাগবাজার স্ট্রিট, ধর্মতলা স্ট্রিট, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কলেজ স্ট্রিটে আবার অবরোধ হয় বেলা দেড়টা নাগাদ। অবরোধ ওঠে ২টোর পরে।
সুদীপ্তর মৃত্যুর প্রতিবাদে আন্দোলনের এই ধারা যে অব্যাহত থাকবে, এ দিনই তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এ দিন সন্ধ্যায় গড়িয়া থেকে নেতাজি নগর পর্যন্ত বামফ্রন্টের মিছিল শুরুর আগে তিনি বলেন, “এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্য জুড়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, যতই হুমকি দিক, মারধর করুক, আন্দোলন বন্ধ করতে পারবে না! বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে আন্দোলন জারি থাকবে।”
বস্তুত, নেতিবাচক রাজনীতিতে ছাত্রদের জড়িয়ে দেওয়া এবং তার জেরে মানুষের দুর্ভোগের কথা মানতেই রাজি নন বাম নেতৃত্ব। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের প্রশ্ন, “ছাত্রদের অধিকার নিয়ে ছাত্ররা ভাববে না তো কে ভাববে? সংবাদমাধ্যম? ইকবাল-আরাবুল?” তাঁর যুক্তি, ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করেই পরের পর ধাপ পেরিয়ে বৃহত্তর আঙিনায় পৌঁছতে হয়। সেলিমের আরও বক্তব্য, “সে দিনের আইন অমান্যের দাবির মধ্যে শিক্ষাঙ্গনকে হিংসামুক্ত করার কথাও ছিল। মিছিলে এমন অনেক ছেলেমেয়ে ছিল, যারা এক বছর ধরে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছে না, অ্যাডমিট কার্ড তুলতে পারছে না। তাদের অধিকার চেয়ে তারা কোথায় যাবে? কলেজের দরজা তো তাদের জন্য বন্ধ!”
এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সওয়াল, “শিক্ষা নীতি ঠিক করে রাজনীতিই। তা হলে রাজনীতিতে ছাত্রদের অধিকার থাকবে না কেন? ১৮ বছর বয়স হলে আমাদের দেশের সরকার গড়ার ভোট দেওয়া যায় আর ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলা যাবে না? অধিকারের জন্য লড়াই করতে গিয়ে সুদীপ্তর যে প্রাণ গিয়েছে, তার বিচার চাইতে তার সতীর্থেরা রাস্তা ছাড়া কোথায় যাবে?” ঋতব্রতের যুক্তি, বহিরাগতদের বাধানো গোলমালের (ভাঙড়, রায়গঞ্জ বা গার্ডেনরিচ) জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখা সমাধান হতে পারে না।
তবে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এ দিন একটি অনুষ্ঠানে ফের জানিয়েছেন, ছাত্র সংসদ ছ’মাসের জন্য বন্ধ আছে। তার পরে আবার এ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ছাত্রদের রাজনীতি করা নিয়ে চিন্তাভাবনার কথা বলেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন-ও। সুদীপ্তর মৃত্যুর সিবিআই তদন্তের দাবির পাশাপাশি ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখার প্রতিবাদ জানিয়ে এ দিনই রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়েছে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদ। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি রাহুল রায়-সহ চার নেতা রাজভবনে দাবিপত্র জমা দেন।
সুদীপ্তের মৃত্যুর প্রতিবাদে রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে এ দিন দিল্লির বঙ্গ ভবনেও বিক্ষোভ দেখায় এসএফআই। পর্যাপ্ত পুলিশ না-থাকায় ব্যারিকেড টপকে ভবনের তিন তলা পর্যন্ত পৌঁছে যায় বিক্ষোভকারীরা। তবে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বঙ্গ ভবন চত্বরের বিক্ষোভে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। উনিই রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী। সরকারের এই অসহিষ্ণুতা বাংলার মানুষ বেশি দিন সহ্য করবেন না!” তাঁরও দাবি, অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচন শুরু হওয়া উচিত। নিজের ছাত্র জীবনের নানা অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে জলপাইগুড়িতে এ দিন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু দাবি করেছেন, ছাত্রদের আইন অমান্য আন্দোলনে মঙ্গলবার পুলিশ যে অমানবিক আচরণ করেছে, এর আগে রাজ্যে তা দেখা যায়নি। এমনকী, কংগ্রেস আমলেও নয়! নেতাদের কোনও ব্যাখ্যাতেই অবশ্য মানুষের হয়রানি এখন আড়াল করা যাচ্ছে না!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.