|
|
|
|
আট বছর পার করেও নিরাপত্তা খুঁজছে বিশ্বভারতী |
মহেন্দ্র জেনা • শান্তিনিকেতন |
বিশ্বকবির নোবেল পদক খুঁইয়েও হুঁশ ফেরেনি বিশ্বভারতীর।
নোবেল চুরির ঠিক আট বছর পূর্তির আগের দিনই বিশ্বভারতীর তথাকথিত ‘হাই সিক্যুরিটি জোনে’ থাকা কেন্দ্রীয় দফতরে গুরুত্বপূর্ণ সব নথি চুরির ঘটনা কার্যত সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে। নোবেল চুরির সময় কিছুদিন হৈচৈ, নানা কমিটি গঠন কেবল হয়েছে। কিন্তু আভ্যন্তরিণ নিরাপত্তা ঠিক যা যা প্রয়োজন ছিল, তার কিছুই পূরণ করেনি বিশ্বভারতী। যার সব থেকে বড় উদাহরণ গত ২২ মার্চ রাতে কেন্দ্রীয় দফতরে চুরি। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবনে আজও পর্যন্ত একটিও সিসিটিভি বসাতে পারেনি বিশ্বভারতী! আগের উপাচার্য রজতকান্ত রায়ের কটাক্ষ, “বর্তমান উপাচার্য নিজের এবং নিজের দফতরের নিরাপত্তা নিয়ে যতটা সচেতন, সামগ্রিক ভাবে গোটা বিশ্বভারতীর নিরাপত্তার জন্য ততটা নন।”
নোবেল চুরির পরে ২০০৪ সালে তৎকালীন বিশ্বভারতীর আচার্য তথা প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর নির্দেশে সিবিআইয়ের প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা তথা ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর প্রাক্তন অধিকর্তা সুজিত ঘোষের সভাপতিত্বে আট সদস্যের এক উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটিতে ছিলেন ভারতীয় জাদুঘরের প্রাক্তন অধিকর্তা শ্যামল চক্রবর্তী, অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস হরিপদ রায়-এর মতো বাঘাবাঘা লোক। তিন মাসের মধ্যেই কমিটি বিশ্বভারতীর নিরাপত্তাকে জোরদার করে তুলতে ৩৭টি সুপারিশ-সংবলিত ৪৬ পাতার রিপোর্ট জমা দেয়।
সুপারিশগুলির অন্যতম ছিল: পুলিশ, বিশ্বভারতীর নিজস্ব নিরাপত্তা বিভাগ ও বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তাকর্মী সহযোগে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তাবলয় গড়া, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনও অফিসারকে বিশ্বভারতীর মুখ্য নিরাপত্তা আধিকারিকের দায়িত্ব দেওয়া, নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে স্থানীয় পুলিশ এর সঙ্গে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ রক্ষা করা, কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গার্ড-পোস্ট, রবীন্দ্র ভবন, কলা ভবন ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রীর জায়গায় ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরা-সহ বৈদ্যুতিন নজরদারি, সীমানা-প্রাচীরের উচ্চতা বাড়ানো, রবীন্দ্র ভবনের কাছে উঁচু নজরমিনার, নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় চেকপোস্ট তৈরি করা, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করা, পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে চেক পোস্ট, নিয়মিত ব্যবধানে সমস্ত শিল্প সামগ্রীর তদারকি করা ইত্যাদি। সুপারিশ করে সুজিতবাবু জানিয়েছিলেন, ‘‘আমরা সুপারিশ করেছি মাত্র। তা কাজে প্রয়োগ করা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।’’ |
 |
চুরির সময়ে ভাঙা ছিল কেন্দ্রীয় দফতরের এই সীমানা প্রাচীর। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী। |
আট বছর পরেও বিশ্বভারতী কি সেই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে?
ঘটনা হল আট বছরেও কমিটির বহু সুপারিশই এখনও কাযর্করই করা হয়নি। কমিটির সুপারিশ মেনে নিরাপত্তা বলয়কে ত্রিস্তরীয় করে তোলা হয়নি। তার বদলে বিশ্বভারতীর নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী কমে দাঁড়িয়েছে ৩০-এ (শান্তিনিকেতনে ২৪, শ্রীনিকেতনে মাত্র ৬)। বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের নিয়োগ করা হলেও তার সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “এখন বিশ্বভারতীতে নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন মাত্র ১৬০-৬৫। এ রকম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অন্তত পক্ষে ৩০০ জনেরও বেশি নিরাপত্তা কর্মী থাকা দরকার।” সম্প্রতি যে কেন্দ্রীয় দফতরে চুরি হল, সেখানে প্রায় ১০ জন নিরাপত্তাকর্মীর প্রয়োজন থাকলেও আদতে থাকতেন মাত্র ২ জন। আর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন অফিসার বিশ্বভারতীর মুখ্য নিরাপত্তা আধিকারিক হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন মাত্র এক মাস আগে। রবীন্দ্রভবন ও কলাভবন ছাড়া অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় (কেন্দ্রীয় দফতর, শ্রীনিকেতন কুঠিবাড়ি ইত্যদি) এখনও সিসিটিভি বসেনি। সীমানা প্রাচীরের উচ্চতা বাড়ানোর কাজও সম্পূর্ণ হয়নি। বসেনি রবীন্দ্রভবনের কাছে কোনও উঁচু নজরমিনারও। গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে এখনও বসেনি ফায়ার অ্যালার্ম ও বার্গলার অ্যালার্ম (আছে কেবল রবীন্দ্র ভবন ও নন্দন আর্ট গ্যালারিতে)।
এ দিকে জেলা পুলিশের সূত্র বলছে, একমাত্র উৎসব ছাড়া নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে পুলিশের সঙ্গে বিশ্বভারতী কোনও যোগাযোগও রাখেনি। অভিযোগ, এমনকী চুরি হওয়া কেন্দ্রীয় দফতরে সীমানা প্রাচীরে নির্মাণের কাজ চললেও সে বিষয়ে বাড়তি কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেনি কর্তৃপক্ষ। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, “এ বিষয়ে বিশ্বভারতীর অবশ্যই স্থানীয় থানাকে জানানো উচিত ছিল।” উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সুপারিশগুলি নিয়ে পরবর্তী সময়ে আর কেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কোনও পদক্ষেপ নিলেন না, এ বিষয়ে বর্তমান আধিকারিকরা অবশ্য চুপ। তবে নোবেল চুরির পরে যিনি উপাচার্যের দায়িত্ব সামলেছিলেন সেই রজতবাবু কিন্তু দাবি করছেন, “কমিটির সুপারিশ মেনে বিশ্বভারতীর জন্য নানা ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। রবীন্দ্র ভবন ও কলা ভবনে সিসিটিভি বসানোর কাজও শুরু হয়েছিল। জানি না, তারপরে কী হল। আসলে বিশ্বভারতীতে এখন একটা অরাজকতা চলছে।” অন্য দিকে, যাঁর সময় নোবেল পদক চুরির মতো কাণ্ড ঘটেছিল, সেই প্রাক্তন উপাচার্য সুজিতকুমার বসুর আবার মত, “কেন্দ্রীয় দফতরের জন্য যে রকম নিরাপত্তা ছিল, তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।”
সরাসরি না বললেও সাম্প্রতিক চুরির নেপথ্যে বিশ্বভারতীরই ভেতরের কোনও লোকের জড়িত থাকার প্রতিই ইঙ্গিত করছেন সুজিতবাবু। তাঁর প্রশ্ন, “বিশ্বভারতীর কোনও কাজে সরকার আপত্তি জানিয়েছে, এমন কোনও নথি বা কোনও কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এমন কোনও কাগজ চুরির জন্য দুষ্কৃতীরা ওখানে ঢোকেনি তো?”
গণ্ডগোল যদি ‘ভেতরেই’ থাকে, তাকে আটকাবে কোন সুপারিশ?
|
(সহ প্রতিবেদন: অরুণ মুখোপাধ্যায়)
|
কার্যকর হয়নি সুপারিশ |
• ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা (পুলিশ-বিশ্বভারতীর নিজস্ব নিরাপত্তা বিভাগ-বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তা কর্মী) গড়ে ওঠেনি।
• রবীন্দ্রভবন ও কলাভবন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসেনি সিসিটিভি।
• শেষ হয়নি সীমানা প্রাচীরের উচ্চতা বাড়ানোর কাজ।
• রবীন্দ্রভবনের কাছে বসেনি কোনও উঁচু নজর মিনার।
• বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফায়ার অ্যালার্ম ও বার্গলার অ্যালার্ম বসেনি।
নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন মাত্র ১৬০-৬৫ জন। এখানে অন্তত ৩০০ জনেরও বেশি নিরাপত্তা কর্মী থাকা দরকার।
— জেলা পুলিশের এক কর্তা। |
|
|
|
 |
|
|