|
|
|
|
আমার ‘স্যার’ |
পালি হিলে নিজের বাংলোয় বসে সেদিন দুপুরে ‘আম্মা’র কথা নাতনি রাইমা-কে শোনাচ্ছিলেন
গুলজার। শোনাতে শোনাতে কেঁদেও ফেললেন।
বিরল সেই মুহূর্তের সাক্ষী ইন্দ্রনীল রায় |
দুপুর দু’টো, রুইয়া পার্ক
কো-অপারেটিভ হাউজিং,জুহু |
রাইমা সেন তাঁর মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে সবে লাঞ্চ সারছেন। “সময় আছে তো? আমি তা হলে চেঞ্জ করে নিই। সাদা সালোয়ার কামিজই ঠিক হবে। উনি তো সাদা পরেন,” মৌরি খেতে খেতে বলেন রাইমা। ঘরের এক দিকে তখন নোটপ্যাডে পড়ে রয়েছে গুলজারের জন্য তৈরি প্রশ্ন। নিজের হাতেই লিখেছেন। গোয়াতে ছুটি কাটানো মুনমুন সেন তার আগে এসএমএসে পাঠিয়েছেন আরও কিছু প্রশ্ন। সেগুলো ঘনঘন দেখছেন সুচিত্রা সেনের বড় নাতনি। |
দুপুর আড়াইটে, কালো স্কোডা গাড়ি, পালি হিল |
“ইউ নো, আজকে সকালে কলকাতার বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় আম্মা-কে বললাম, আই উইল বি মিটিং গুলজার। শুনলেন। একটু হাসলেন। তার পর আর কথা বললেন না।” গাড়ি প্রায় পৌঁছে গিয়েছে ‘বসকিয়ানা’। নিজের মেয়ের নামে সাদা দোতলা বাড়ি গুলজারের। তিনটে বাংলো পরে সপরিবারে থাকেন ঋষি কপূর। একটু দূরেই দিলীপ কুমার। গাড়ি থেকে নেমে, রাস্তা ক্রস করে বেল বাজাতেই সেক্রেটারি ভেতরে নিয়ে গেলেন রাইমাকে। |
‘বসকিয়ানা’, গুলজার সাবের বাড়ি |
ঘরে ঢুকেই দেখলাম এক মনে নিজের টেবিলে কী যেন লিখছেন। পরে জানলাম, এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করছেন হিন্দিতে। তারই কাজ চলছে। স্তূপীকৃত কাগজ এক দিকে, রয়েছে অ্যাপল-এর ল্যাপটপ। এক কোণে পড়ে আই ফোন। ঘরে নানা পেন্টিং, এক দিকে বিভিন্ন কাগজে প্রকাশিত তাঁর কার্টুন স্কেচ। সেগুলো সযত্নে বাঁধানো। দেওয়ালে অজস্র পেন্টিং। “আও আও বেটি।” রাইমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। স্পষ্ট বাংলায় বললেন, “কোথায় বসবে বলো?” রাইমা তখন এ দিক ও দিক দেখছেন। “যেখানে তুমি কমফর্টেবল, সেখানে বসো। আমার বাড়ি তো, আমি সব জায়গাতেই কমফর্টেবল,” আস্তে আস্তে বললেন তিনি। পাশে রাখা সোফাটায় বসা হল।
মুখোমুখি গুলজার এবং রাইমা সেন।
আসলে ওঁরা কেউ নন---পুরো ঘর জুড়েই তখন সুচিত্রা সেন। |
|
|
ছবি: ইন্দ্রনীল রায় |
|
|
একশো বছর ধরে ওঁর
সঙ্গে প্রেম করছি |
“কেমন আছেন উনি? আমাদের কথা কখনও বলেন?” সেই বিখ্যাত গলায় রাইমাকে প্রশ্ন তাঁর। “ হ্যাঁ, বলেন তো বটেই। উনি জানেন আমি আপনার কাছে এসেছি। আর কিছু পড়ুন, না পড়ুন আপনার সঙ্গে এই ইন্টারঅ্যাকশনটা ‘আম্মা’ পড়বেনই,” বললেন মুনমুন সেনের কন্যা।
পেশাদার সাংবাদিক প্রশ্ন করেন গুলজারকে।
স্যার, খুব মিস করেন না আপনার ‘আঁধি’র হিরোইনকে? সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা কবি, পরিচালক, গীতিকার চোখ নামিয়ে নেন। ঘাড় বেঁকিয়ে নাতনির দিকে তাকিয়ে বলেন, “বেটি ওঁকে বোলো, একশো বছর ধরে আমি ওঁর সঙ্গে প্রেম করছি, আরও একশো বছর যেন ওঁকে ভালবাসতে পারি। আমার মনে যেন উনি সারা জীবন থাকেন। কোনও দিন কোথাও যেন ছেড়ে চলে না যান ।” ঘর তখন নিস্তব্ধ।
গুলজারের চোখে জল। রাইমারও।
এর মধ্যেই চা ঢোকে ঘরে। |
আজও উনি আমার ‘স্যার’ |
“তোমরা আজকালকার নায়িকারা তো আবার চিনি খাও না,” রাইমার কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বলেন তিনি।
তার পর নিজেই বলেন, “বেটি তুমি কি জানো আমি ওঁকে স্যার বলি?”“হ্যাঁ, জানি। গত সপ্তাহে আম্মা বলছিল ‘আঁধি’র সময় থেকেই নাকি আপনি ‘স্যার’ বলে ডাকেন আম্মাকে,” হেসে বলেন রাইমা।
হেসে ওঠেন গুলজার। “ও তাই, ওঁর মনে আছে? আমার তখন কীই বা বয়স। সেটে ঢুকে দেখি সুচিত্রা সেন আমাকে বলছেন, “স্যার, কোথায় দাঁড়াব, স্যার আমার ডায়লগ কী?’’ আমি তো লজ্জায় লাল। সাহস করেই আমি বললাম, আপনি যদি ‘স্যার’ বলেন আমায়, তা হলে পুরো ইউনিট আপনাকে ‘স্যার’ বলবে। সেই থেকে শুরু। আজও উনি আমার ‘স্যার’,” চা খেতে খেতে বলেন আর ডি বর্মনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু।
তার পর হঠাৎই উদাস হয়ে রাইমাকে জিজ্ঞেস করেন একটার পর একটা প্রশ্ন। “উনি লেখালিখি করেন? ওঁর দিন কী ভাবে কাটে? জানো তোমাদের উচিত ওঁর সব কথা রেকর্ড করা। সিনেমার বয়স একশো বছর হলেও ওঁর অভিজ্ঞতা সিনেমার বয়সের থেকেও বেশি। ওঁর কাছে কত গল্প আছে ভাবো তো! সেগুলো যত পারবে, শুনবে। তোমাদের জীবন সমৃদ্ধ হবে,” স্নেহমিশ্রিত পরামর্শ তাঁর।
রাইমা মাথা নেড়ে বলেন, “তুমি বলছ রেকর্ড করতে, আম্মা যদি জানে ওঁর কথা আমরা রেকর্ড করছি, শি উইল কিল আস।” হেসে ওঠেন দু’জনে।
কথা চলে নানা বিষয়ে। “আমি মনে করি, ওঁকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার এখনই দেওয়া উচিত। উত্তমকুমারকে না দেওয়াটা ভারতীয় সিনেমার একটা লজ্জাজনক অধ্যায়। ওঁর ক্ষেত্রে যেন আর সেটা না হয়,” স্পষ্ট কথা তাঁর।
“কিন্তু আমি এটাও জানি, উনি নিতে আসবেন না। সুচিত্রা সেনকে কেউ ডিক্টেট করতে পারে না। উনি নিজে যেটা মনে করবেন সেটাই হবে। ওঁর ব্যক্তিত্বটাই যে সবার থেকে আলাদা,” চায়ের কাপটা নামিয়ে বলেন ‘সম্পুরন সিংহ’। |
সুচিত্রা সেন হচ্ছেন
ভগবান কৃষ্ণ |
পুরোনো দিনের কথায় ফিরে যান গুলজার ।
“জানো রাইমা, ‘দেবদাস’-এর পর থেকেই পুরো মুম্বইতে ওঁকে নিয়ে মানুষের যে কী কৌতূহল ছিল তা বলে বোঝাতে পারব না। টু মি, সুচিত্রা সেন ইজ লাইক লর্ড কৃষ্ণ। দেখবে, ভগবান কৃষ্ণ একবার যে জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছেন, সেখানে আর ফিরে যাননি কোনও দিন। বৃন্দাবন ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আর বৃন্দাবন ফেরেননি। দ্বারকা ছেড়ে দেওয়ার পর আর যাননি দ্বারকায়। মথুরা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আর মথুরামুুখো হননি। সুচিত্রা সেনও তাই। এক বার যে রোল করেছেন, সেগুলোর দিকে আর ফিরেও তাকাননি। এতেই মানুষের আসল চরিত্রটা বোঝা যায়। আমার কাছে ‘স্যার’ হচ্ছেন লর্ড কৃষ্ণ,” এক নিশ্বাসে বললেন অস্কারজয়ী গীতিকার। রাইমার চোখেমুখে তখন গর্বিত হাসি।
“মা বলছিল আপনি বাঙালি ও বাঙালি মেয়েদের খুব পছন্দ করেন। তাই না?”
“হা হা হা। শুধু বাঙালি মেয়ে নয়। কী যে বলিস তুই বেটি? আমার তো বাংলার সঙ্গে লাইফ লং প্রেম। প্রথম প্রেমে পড়ি বাংলা ভাষার। সেই স্কুলে যে দিন প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ পড়লাম, সেদিন থেকে শুরু। তার পর ভাষাটা শিখলাম। তার পর ‘বঙ্গালন’ তো স্বাভাবিক একটা প্রোগ্রেশন,” হাসতে হাসতে বলেন তিনি।
তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল কলকাতা এলেই সুচিত্রা সেনকে ফোন করাটা ওঁর অবশ্যকর্তব্য। “কলকাতায় নেমে প্রথম ফোনটা ওঁকেই করি। বহু বছর ধরে এটাই নিয়ম। কিন্তু শেষ দু’বার কথা হয়নি। মনু (মুনমুন সেন)-কে ফোন করেছিলাম। মনু বলল, এ বারটা ছেড়ে দাও। তার পর নিজেই বলল তুমি আবার আমার নাম কোরো না। বকুনি খাব আমি। আজও সবাই ভয় পায় ওঁকে। কী রাইমা?”
রাইমা তখন সম্মতিসূচক হাসি হাসলেন। “হ্যাঁ, খুব ভয় পাই।
আজও যদি উনি বলেন রাইমা,
দু’টোর সময় আমরা খেতে বসব, তা হলে সেটা দু’টোই হবে। এক
মিনিট লেট হলেও চলবে না। উনি এ রকমই।”
|
|
|
নিজের সিডিতে সই করে ‘স্যার’-কে উপহার
পাঠালেন গুলজার। ছবি: গজানন দুধলকর |
কন্যাসমা রাইমাকে জড়িয়ে ধরলেন
গুলজার। ছবি: গজানন দুধলকর |
|
ওটা টোটাল ইন্দিরা গাঁধী |
কথায় কথায় স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে ‘আঁধি’র প্রসঙ্গ।
গুলজার সাবের কথা থেকেই জানা যায়, ছবির প্রযোজক জে ওমপ্রকাশকে ওয়ান লাইনার শোনানোর পরেই উনি সম্মতি দেন চিত্রনাট্যটা লেখার। ওয়ান লাইনার নাকি উনি রাখি এবং তাঁর এক সাংবাদিক বন্ধুকেও শুনিয়েছিলেন। ‘‘ওদের দু’জনেরই ভাল লেগেছিল। তিন দিন পরে দেখি রাখি আমাকে জিজ্ঞেস করছে, আচ্ছা ওই ইন্দিরা গাঁধীর ছবিটার কী হল? আমি বলেছিলাম আরে ইন্দিরা গাঁধী নয়, ওটা এক জন মহিলা রাজনীতিবিদের গল্প। কিন্তু রাখি মানেনি। ঠিকই করেছিল। কারণ রোলটার মডেল ছিল ইন্দিরা গাঁধী। হাঁটা চলা, ফাইল হাতে
নেওয়া, চুলটা পুরোটাই ১০০ শতাংশ ইন্দিরা গাঁধী। টোটাল ইন্দিরা গাঁধী। ওই অভিনয় ‘স্যার’ ছাড়া কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়,” এক নিশ্বাসে বলেন পরিচালক।
নিজেই বলেন ‘আঁধি’র নানা অজানা তথ্য। দিল্লির আকবর হোটেলে নাকি টানা এক মাস একটি ঘরে বসে চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। “এক মাস ঘর থেকে বেরোইনি। আমাকে সার্ভ করত একটি ওয়েটার, তার নাম ছিল জেকে। এক মাস সে আমাকে এত যত্নে রেখেছিল যে আমি ভাবলাম তার ঋণ শোধ করা উচিত। যেহেতু ওর নাম ছিল জেকে, আমি আমার নায়কের নামও জেকে রেখেছিলাম,” হাসতে হাসতে বলেন গুলজার।
মন দিয়ে সব গল্প শুনছিলেন রাইমা। তার পর নিজেই প্রশ্ন করেন, “আচ্ছা কখনও রাখিজি আপনাকে বলেননি আপনি ওঁকে কেন কাস্ট করেননি?”
“হা হা হা হা, হ্যাঁ করেছিল। কিন্তু আমাদের বাড়িতেই কথা হয়ে গিয়েছিল যে সেটা সম্ভব নয়। তার কারণ আমার কাছে রাখির পরিচয় সব সময়ই আমার স্ত্রী হিসেবে। সেই পরিচয়টা আমি মাথা থেকে সরাতে পারিনি। তাই কোনও দিন কাস্ট করতে পারিনি ওকে। আমাকে দুর্বল পরিচালক বলতে পারো, দুর্বল পুরুষ বলতে পারো, আবার খুব সৎ মানুষও বলতে পারো। কিন্তু আমার কাছে রাখির প্রথম ও শেষ পরিচয় আমার স্ত্রী হিসেবেই। এই মানসিকতায়
কাস্ট করলে সেটা অসততা হত,” বলেন তিনি। |
ওই দু’টো লাইন শুনিয়ে দাও |
শু্যটিংয়ের গল্পে ফেরেন গুলজার সাব। “‘আঁধি’ ছবিটা দেখলে বুঝবে, পুরো ফিল্মে ‘স্যার’-এর চোখে সারা ক্ষণ জল রয়েছে। হার আইজ ওয়্যার ময়েস্ট থ্রু আউট দ্য ফিল্ম। জানো কী ভাবে করতেন উনি?” প্রশ্ন করেন নাতনিকে।
তার পর নিজেই শুরু করেন বলা।
“শু্যটিংয়ের সময় আমার কাছে টেপ-রেকর্ডার থাকত। ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই শিকওয়া তো নহি’ গানটা তত দিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে। কাশ্মীরে আউটডোর চলছে। শট শুরু হবে, তার ঠিক আগে ‘স্যার’ আমাকে বলতেন, আমাকে ওই লাইনটা একটু শুনিয়ে দাও তো সেই লাইনটা ছিল ‘তুম যো কহে দো তো, আজ কি রাত চাঁদ ডুবেগা নহি...রাত কো রোক লো।’ চোখ বন্ধ করে লাইনটা মন দিয়ে শুনতেন। তার পর বলতেন চলো, শুরু করি। দেখতাম চোখে জল। আমি এ রকম আর্টিস্ট দেখিনি।”
চুপ করে থাকেন কয়েক মুহূর্ত। গলা নামিয়ে বলেন, “‘আঁধি’র শু্যটিংয়ের সময় ওঁর সব দৃশ্যের আগে এটাই ছিল রুটিন। আজও ওঁর গলাটা কানে বাজে, ‘ওই লাইনটা শুনিয়ে দাও তো।’ এটাই হলমার্ক অব আ গ্রেট আর্টিস্ট, যে একটা বিন্দুতে মনঃসংযোগ করে সেটার আশেপাশে অভিনয়টাকে সাজায়,” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন গুলজার।
চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, “আর ছিল হরিভাই। ‘স্যার’ যদি গানের দু’লাইন শুনে চোখে জল আনতেন, হরিভাইয়ের ছিল অন্য স্টাইল। ও কী করত (হাতের মুদ্রা নিজেই করে দেখালেন রাইমাকে), মাথা নিচু করে কড়ে আঙুল দু’টো দিয়ে চোখের কোনায় চাপ দিত তিরিশ সেকেন্ড। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে চোখে জল। ভাবা যায়, এরা কী পর্যায়ের অভিনেতা ছিল! বহু দিন দেখেছি এক ফোঁটা চোখের জল ঠিক চোখের উপর রেখে অভিনয় করেছেন ‘স্যার’। এটা আমার কাছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আর্ট। রাইমা বেটি, পারলে শিখে নিও আম্মার কাছে। ওঁর থেকে ভাল শিক্ষক আর পাবে না পৃথিবীতে,’’ পরামর্শ দেন নাতনিকে।
“আচ্ছা, আউটডোরে শু্যটিংয়ের পর কী করতেন আপনারা?” প্রশ্ন করেন রাইমা।
“রাখিজি রান্না করতেন। আমরা আড্ডা মারতাম। বিটিয়া রানি, তুমি এখানে আছ, কী বলি তোমায়। শু্যটিংয়ের পর হরিজি আর ‘স্যার’ উড ‘ফুল’ অ্যারাউন্ড। নাতনির সামনে তো আর ‘ফ্লার্ট’ শব্দটা বলতে পারি না। তাই ‘ফুলিং অ্যারাউন্ড’ বলছি,” দরাজ কণ্ঠে বলেন তিনি। বলতে বলতে রাইমার হাতটা ধরেন।
রাইমাও হাসছেন। একটু লজ্জিত। |
এ কী! হিটলারকে এ রকম বেঁধে কে রাখল |
কথায় কথায় জানা যায়, সুনীল দত্তের প্রিভিউ থিয়েটার, ‘অজন্তা’য় ‘আঁধি’ দেখার পর সুচিত্রা সেনের একেবারেই পছন্দ হয়নি ছবিটা। গুলজারের ক্যামেরাম্যান বলেছিলেন, “ইয়ে তো নিউজপেপার বনা দিয়া”। রাখি বলেছিলেন, “এটা একটু বায়োগ্রাফি বায়োগ্রাফি লাগছে, সিনেমা নয়।” কিন্তু গুলজার দমেননি।
“আমি এটুকু জানতাম, যেটা লিখেছি, সেটা ঠিক শু্যট করতে পেরেছি। আমার কাছে সেটাই আসল,” স্পষ্ট স্বীকারোক্তি তাঁর। তার পরের গল্প অবশ্য আজ ইতিহাস।
আবার গুলজার ফেরেন তাঁর ‘স্যার’-এর কথায়।
“এত গল্পের মাঝে, আজ হঠাৎ করে মনে হচ্ছে আমি ‘স্যার’-এর সঙ্গেই রয়েছি। কত কথা মনে পড়ছে। এক বার কলকাতা গিয়েছিলাম। তখন ওঁর পিঠে ব্যথা। খাটের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে উনি স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করছিলেন। আমি তো সব চেয়ে প্রিভিলেজড। আমার ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিল। ওঁকে দেখে আমি বললাম, ‘এ কী! হিটলারকে এ রকম বেঁধে কে রাখল?’ আমার কথা শুনে খুব হেসেছিলেন। আর একটা জিনিসও উনি করতেন যা আমি পৃথিবীর অন্য কাউকে করতে দেখিনি। বালিগঞ্জের পুরোনো বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের হাতে কাকদের খাওয়াতেন। তাঁর হাত থেকে সুন্দর করে কাকেরা খেয়ে যেত। এটাও কোনও দিন দেখিনি অন্য কাউকে করতে,’’ চশমা মুছতে মুছতে বলেন গুলজার। |
বাকি দিনটা আর সারা রাত আমার কাটবে কী করে |
তত ক্ষণে আড্ডা শেষ। চলছে ছবি তোলার পর্ব। এর মধ্যেই নিজের কিছু সিডি ও বই রাইমার জন্য নিয়ে এলেন। নিজে হাতে ‘স্যার’-এর জন্য দু’লাইন লিখলেন সিডি কভারে। তার পর এই সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর ছবি তুলো না। আমি একটু রাইমাকে নিয়ে বেরোতে চাই।”
রাইমাও তখন হতচকিত।
ড্রয়ার থেকে নিজের ক্রেডিট
কার্ড বের করলেন। ধীরে ধীরে
বললেন, “আমার বাড়ির পাশেই ফ্যাব ইন্ডিয়া। কিছু কিনে আনি তোমার আর ‘স্যার’-এর জন্য।” বেরিয়ে
গেলেন রাইমার হাত ধরে।
ফিরলেন দশ মিনিট পরে।
রাইমার হাতে তখন ফ্যাব ইন্ডিয়ার ব্যাগ। তাতে রয়েছে প্রিয় ‘স্যার’ ও তাঁর নাতনির জন্য গুলজার সাবের কিনে দেওয়া উপহার।
এক বার ভেবেছিলাম লুকিয়ে ছবি তুলেই নিই। ‘আঁধি’র পরিচালক, সুচিত্রা সেনের জন্য উপহার কিনেছেন সুচিত্রা সেনের নাতনির সঙ্গে এই ছবি তো সুপার এক্সক্লুসিভ!
কিন্তু আগামী কাল যাঁর জন্মদিন, সেই মানুষটি এতটাই প্রাইভেট, তাঁর প্রাইভেসি এনক্রোচ করতে ইচ্ছে করেনি আর।
তত ক্ষণে গেট অবধি পৌঁছে গিয়েছেন রাইমা। দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন গুলজার সাব। রাইমা এগিয়ে যান তাঁর দিকে। জড়িয়ে ধরেন।
রাইমার দিকে তাকিয়ে শুধু বলেন, “আজকের বাকি দিনটা আর সারা রাত আমার কাটবে কী করে? আজ তুমি আমায় আবার সুচিত্রা সেনের কাছে নিয়ে গেলে। সারা রাত, ওঁর সঙ্গে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা ভাবব,” গলা ধরে আসে তাঁর।
‘প্রবীণ প্রেমিক যেন স্মৃতির গহনে দিয়ে ডুব।’ ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসেন রাইমা।
বন্ধ হয়ে যায় ‘বসকিয়ানা’র দরজা। |
|
|
|
|
|