রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বিরোধ গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। ভোট পরিচালনায় কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার খরচের বহর ঘিরেও এ বার বিতর্ক তৈরি হল।
কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর পক্ষে গোড়া থেকেই সওয়াল করে আসছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। তাদের দাবি: রাজ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে হলে ভোট হতে হবে তিন দফায়। আর তার জন্য চাই ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তা এখনও মানেনি। উল্টে রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় কমিশনের দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, “আটশো কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী আনতে রাজ্যের চারশো কোটি খরচ হবে। এত টাকা কোথায়? তাই কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রশ্ন নেই।” সুব্রতবাবু জানিয়েছেন, নির্বাচন পরিচালনার জন্য কমিশন দু’শো কোটি টাকা চেয়েছিল, যার একশো কোটি রাজ্য ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু আটশো কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর পিছনে চারশো কোটি টাকা খরচের কথা পঞ্চায়েতমন্ত্রী কী হিসেবে বললেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। তাদের বক্তব্য: ওই পরিমাণ কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোটপর্ব সারতে শ’-সওয়াশো কোটির বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ মন্ত্রীর হিসেবের এক-চতুর্থাংশ বা তার একটু বেশি। এবং এটা তারা নিজেরা রীতিমতো হিসেব কষে দেখেছে বলে কমিশন-সূত্রের দাবি। কী রকম?
কমিশনের হিসেব: এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী (৮০-১০০ জন) এক দিন মোতায়েন রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে রাজ্যের তরফে দিতে হয় ৭০ হাজার টাকা। সঙ্গে জওয়ানদের রেল-সড়কপথে যাতায়াত ও থাকার খরচ। খাওয়ার খরচ অবশ্য জওয়ানদের নিজেদের পকেট থেকে যায়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য: ভোট করাতে আসা নিরাপত্তাবাহিনীকে রাখার জন্য সরকার বহু স্কুল-কলেজের দখল নেয়। একই ভাবে ভোটের সময়ে বাস-সহ প্রচুর বাণিজ্যিক গাড়ি হুকুম-দখল করা হয়। সুতরাং বাহিনীর থাকা-যাতায়াত বাবদ খুব বেশি খরচ হওয়ার কথা নয় বলেই মনে করছে কমিশন।
এর পরে আসছে পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের মেয়াদের প্রসঙ্গ। কমিশনের বক্তব্য: পুরো পর্ব জুড়ে সব সময়ে আটশো কোম্পানির প্রয়োজন নেই। এক মুখপাত্রের কথায়, “মনোনয়ন পেশের সময় দশ দিনের জন্য তিনশো কোম্পানি দরকার। আর ভোটের সময়ে আরও দশ দিন চাই আটশো কোম্পানি, যদি দু’দফায় ভোটগ্রহণ হয়। তিন দফায় হলে পনেরো দিন। সব মিলিয়ে দিন পঁচিশের বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন হওয়া উচিত নয়।” এবং এই বাবদ রাজ্য সরকারের বড়জোর ১০০-১২৫ কোটি টাকা খরচ হতে পারে বলে দাবি করছেন ওই মুখপাত্র। “বাহিনী যত কম দিন থাকবে, খরচ তত কমবে।” মন্তব্য তাঁর।
এবং এরই প্রেক্ষিতে পঞ্চায়েতমন্ত্রীর দেওয়া চারশো কোটির হিসেব নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। বস্তুত মন্ত্রীর হিসেবের সঙ্গে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের একটি মহলও ভিন্নমত। প্রসঙ্গত, রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র দফতরই দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। ক’বছর যাবৎ জঙ্গলমহল ও দার্জিলিং পাহাড়ে যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন রয়েছে, তার যাবতীয় দায়-দায়িত্বও স্বরাষ্ট্র দফতরের। ফলে কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার খরচ সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা রয়েছে। পঞ্চায়েতমন্ত্রীর দাবি প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র-কর্তারা অবশ্য প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ। যদিও জনান্তিকে তাঁদের কয়েক জনের মন্তব্য, “বড্ড বাড়াবাড়ি রকম খরচ দেখানো হচ্ছে।” কত খরচ হতে পারে?
এক দিন এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখতে কত টাকা লাগে, তার চুলচেরা হিসেব দিতে না-পারলেও স্বরাষ্ট্র-কর্তাদের একাংশ মেনে নিচ্ছেন যে, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দাবির বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। উপরন্তু ওঁরা একটি নতুন তথ্যও দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখার টাকা চেয়ে মাঝে-মধ্যেই নয়াদিল্লির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রাজ্যকে চিঠি পাঠিয়ে তাগাদা দিয়ে থাকে। যার জবাবে রাজ্য হামেশাই নীরবতা অবলম্বন করে। এই বাবদ রাজ্যের কাছে দিল্লির বিস্তর পাওনা জমে রয়েছে বলে মহাকরণ-সূত্রের ইঙ্গিত।
খরচের হিসেবের পাশাপাশি বাহিনীর ‘চরিত্র’ নিয়েও শুরু হয়েছে টানাপোড়েন। কমিশনের দাবি: পঞ্চায়েত ভোট হোক কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে। রাজ্যের বক্তব্য: নিজেদের সশস্ত্র বাহিনী দিয়েই ভোট করানো যাবে, প্রয়োজনে অন্য রাজ্য থেকে বাহিনী আনা যেতে পারে। অর্থাৎ, পঞ্চায়েত ভোটে ‘কেন্দ্রীয়’ বাহিনী আনতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ঘোরতর আপত্তি। এ দিকে রাজ্য প্রশাসনের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর হয়ে কার্যত অন্য রাজ্যের জওয়ানেরাই আসেন। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে বিতর্ক কেন? কমিশনই বা কেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিতে অনড়? সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা: সাধারণ ধারণা হল, কেন্দ্রীয় বাহিনী কোনও রাজ্যে গেলে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করে। সেই ধারণার বশবর্তী হয়েই কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা-ছত্রচ্ছায়ায় পঞ্চায়েত ভোট আয়োজনের পক্ষপাতী কমিশন। অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের আশঙ্কা, কেন্দ্রে যে হেতু কংগ্রেসের সরকার, তাই দিল্লি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে শুধু কংগ্রেসশাসিত রাজ্যগুলো থেকে বাহিনী পাঠাতে পারে। এবং সে ক্ষেত্রে তারা নামে ‘কেন্দ্রীয়’ হলেও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে পারে। প্রশাসনিক সূত্রের ব্যাখ্যা, এই আশঙ্কার ভিত্তিতেই মমতা সরকার প্রয়োজনে অ-কংগ্রেসি রাজ্য থেকে বাহিনী আনতে চাইছে।
তবে এই জাতীয় ধারণা বা সংশয়ের বাস্তব ভিত্তি কতটা, রাজ্য প্রশাসনের অন্দরে সে প্রশ্নও উঠেছে। “উর্দির রং এক হলেও বাহিনীর ঠিকানা নিয়ে কার্যত রাজনীতি-ই হচ্ছে!” বলছেন রাজ্য প্রশাসনের এক মুখপাত্র। |