প্রবন্ধ ১...
টি এন শেষন থেকে মীরা পান্ডে
ঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে রাজ্য রাজনীতি এখন সরগরম। রাজ্য নির্বাচন কমিশন অবশেষে আদালতের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছে। অন্য দিকে, রাজ্য সরকার তথা তৃণমূল কংগ্রেস দল রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে নেমে পড়েছে। পথে নেমে পড়েছে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দল।
এই ঘটনায় অনেকে অবাক হয়েছেন। কারণ, পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। এ কথা ঠিক যে, বিগত তেইশ মাসে বহু ঘোষিত পরিবর্তনের রং চটে জেল্লা কমার কারণে ‘মমতা ম্যাজিক’ অনেকাংশে ফিকে হয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, তাতে সি পি আই এম-এর প্রতি মানুষের রোষ তেমন ভাবে কমেনি। বামপন্থীদের প্রতি আস্থা ফিরে আসেনি। গ্রামাঞ্চলে বামপন্থীরা মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। এই পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্যই প্রত্যাশিত ছিল। আপাতদৃষ্টিতে তাই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংঘাতকে অপ্রয়োজনীয় এবং আত্মঘাতী বলে মনে হতে পারে।
কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই এই সংঘাতের আসল কারণ উন্মোচিত হয়। পঞ্চায়েত যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতেই তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই সত্য যে, বিরোধীদের থেকে নয়, তৃণমূল কংগ্রেসের আসল চ্যালেঞ্জ আসছে তৃণমূল কংগ্রেস থেকেই। দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের প্রশ্নে ইতিমধ্যে প্রতিটি অঞ্চলেই দল বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং এই সংঘাত ক্রমবর্ধমান। পশ্চিমবঙ্গের বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক সংঘাতের ক্ষেত্রে এখন প্রধান উপাদান তৃণমূল কংগ্রেস বনাম তৃণমূল কংগ্রেসের লড়াই। দলীয় নেতৃত্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই ভীতিকর বাস্তবতা যে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে যত সাফল্যই আসুক, নির্বাচন শেষে খণ্ডবিখণ্ড শক্তি নিয়ে ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে নামা সমীচীন হবে না। তাই, যে তৃণমূল কংগ্রেস দল একদা অধীর আগ্রহে পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য প্রতীক্ষারত ছিল, তারাই এখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফাঁস থেকে মুক্তি চাইছে। ঘটনা হল, পঞ্চায়েত নির্বাচন স্থগিত হলে তৃণমূল কংগ্রেসের লাভ বই ক্ষতি নেই। কারণ, ইতিমধ্যেই নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের হারিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করে সরাসরি ক্ষমতা অনুশীলনের স্বাদ তৃণমূল নেতারা পেয়ে গেছেন। মমতাদেবী যখন সিএম টু বিডিও মাইনাস ডিএম লাইনের কথা বলেন, তখন এই সত্যই উঠে আসে। সন্দেহ নেই যে, কালক্রমে এই লাইন সিএম টু টিএম অর্থাৎ তৃণমূল হবে। মনে করার কারণ আছে যে, নতুন এই চেতনার উন্মেষে মমতাদেবী সাংবিধানিক দৃঢ় ভিত্তি নেই জেনেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েছেন।
আক্রমণ। লক্ষ্যের নাম রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
এই যুদ্ধের পরিণাম কী হবে, তা আদালতই বলবেন। তবে পরিপ্রেক্ষিতটা মনে রাখা ভাল। সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪তম সংশোধনীর পর পঞ্চায়েত ও পুরসভা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে প্রণীত আইনে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক সংস্থা হিসাবে আইনের সংস্থান রাখা হয়েছে। সংবিধানে ৩২৪ ধারায় ভারতের নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের প্রশ্নে যে সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটাই সংবিধানের ২৪৩ (কে) ও ২৪৩ (জেড-এ) ধারা মোতাবেক ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইন, ১৯৯৪ মোতাবেক রাজ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত রয়েছে। ফলে, পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের সমূহ দায়িত্ব ও অধিকার একমাত্র রাজ্য নির্বাচন কমিশনের রয়েছে, যে ক্ষমতা স্পষ্ট, মুক্ত ও অগাধ নির্বাচনের স্বার্থে রাজ্য নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
সুষ্ঠু ও অবাধ পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচনের জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সার্বভৌম ক্ষমতা ও প্রক্রিয়া নিয়ে যেটুকু ধোঁয়াশা ছিল, সুপ্রিম কোর্টের অন্তত চারটি রায়ে তা স্পষ্ট হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দিগ্দর্শী ভূমিকা নিয়েছে ২০০৬ সালে কৃষ্ণ সিংহ তোমর বনাম আমদাবাদ পুরসভা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চের রায়, যেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে, “পঞ্চায়েত ও পুর নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মর্যাদা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মতোই। সংবিধানের ৩২৪ ধারায় জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ২৪৩ কে ও ২৪৩ জেড এ ধারায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনকেও সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।... পঞ্চায়েত ও পুরভোট পরিচালনা, ভোটার তালিকা তৈরি ও ভোটের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের আওতার সম্পূর্ণ বাইরে থেকে কাজ করবে। ২৪৩ কে (৩) ধারাতেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আছে।” ওই ধারা অনুযায়ী রাজপালকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী সরবরাহ করতে হবে। নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সাহায্য করতে যা যা প্রয়োজন তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতকে গুরুত্ব দিতে হবে। উত্তরপ্রদেশে ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিলের রায়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীর ও বিচারপতি নির্জরের ডিভিশন বেঞ্চ অভিন্ন রায় দেন।
এ সবের তাৎপর্য মমতাদেবীর না-বোঝার কথা নয়। তাই, আদালতের রায়ের অপেক্ষায় না-থেকে তিনি এই প্রক্সি যুদ্ধে তাঁর দুই প্রতিনিধিকে এগিয়ে দিয়েছেন। পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতা, সাংসদ মুকুল রায়। এই দু’জন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে অকাতরে বিবিধ মণিমাণিক্য বিতরণ করে চলেছেন।
রাজ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে কয়েক দফা চিঠি চালাচালির পর সুব্রতবাবু কমিশনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দু’দফা ভোটের দিনক্ষণ ও অঞ্চল বিভাগ এক তরফা ভাবে ঘোষণা করে দেন। তাঁর হাতিয়ার হয় ২০০৩ সালে রাজ্য বিধানসভায় প্রণীত আইনের ৪২ ‘ক’ ধারা, অথচ ওই ধারাতেই কমিশনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ভোটের দিন ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। চিঠি চালাচালিকে কি আলোচনা বলা যায়? আলোচনার অর্থ সদর্থক সক্রিয় আলোচনা, যার মাধ্যমে সহমত অর্জনের ভিত্তিতেই এমন ঘোষণা করা যায়! সুব্রতবাবু বুঝতেই পারছেন না, অন্য রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া পঞ্চায়েত নির্বাচন হলেও শুধু পশ্চিমবঙ্গের কেন কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রয়োজন। তিনি ভুলে বসে আছেন যে, শুধু এই রাজ্যেই দলীয় প্রতীক নিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়, অন্য রাজ্যে দলহীন পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলে দলীয় হানাহানির প্রশ্ন ওঠে না।
তবে সুব্রতবাবু তুলনায় সংযতবাক। মুকুলবাবু কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে ‘ষড়যন্ত্রী’ হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। তাঁর সরল সমীকরণ হল, যেহেতু তিনি বাম জমানায় এই পদে বসেছেন, তাই বামফ্রন্টের স্বার্থ দেখার কারণেই তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনে রাজি হননি। মুকুলবাবু ভুলে গিয়েছেন, ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ সম্পূর্ণ না করে নির্বাচন করা যায় না। মুকুলবাবুর কথা মানলে ২৬ লক্ষ নতুন ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সংরক্ষণের জন্য বিজ্ঞপ্তি জরুরি ছিল। এর থেকেও মারাত্মক হল তাঁর এই হুমকি যে, গরমকালে নির্বাচনে এক জন লোকও মারা গেলে তাঁরা মৃতদেহ কমিশন অফিসে এনে জবাবদিহি চাইবেন! তিনি ভুলে গিয়েছেন, ১৯৮৮ সাল বাদ দিয়ে বিগত সব নির্বাচনগুলি, এমনকী যে নির্বাচনে তাঁরা ক্ষমতাসীন হয়েছেন সেই নির্বাচনও এপ্রিল-মে মাসে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালেই হয়েছে। মুকুলবাবু ঘোষণা করে দিয়েছেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজ্যপালের কাছে যেতেই পারেন, কিন্তু রাজ্যপালের কোনও ক্ষমতাই নেই! অথচ রাজ্যপালেরই সেই ‘স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা’ রয়েছে, যা দেশের রাষ্ট্রপতিরও নেই। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সামনে সাড়ম্বরে সংবিধানের কপি তুলে ধরে মুকুলবাবু ঘোষণা করেন যে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন রাজ্যের এক্তিয়ারে, এখানে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের নাক গলানো সহ্য করা হবে না। সাধারণ আইনশৃঙ্খলা এবং নির্বাচনী আইনশৃঙ্খলা যে দুটো আলাদা প্রশ্ন, তা-ও কি তিনি জানেন না?
এই ভাবে নির্বাচন স্থগিত হলে এবং আশু জট না কাটলে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের আগে আর পঞ্চায়েত নির্বাচন করা কঠিন হতে পারে। কারণ, এর পর বর্ষার জন্য তিন মাস এবং পুজোর জন্য মাস তিনেক গ্রামাঞ্চলে নির্বাচন সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে মমতাদেবী প্রশাসক নিয়োগ করে ও অধ্যাদেশ জারি করে একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে সরাসরি আরও বেশি ক্ষমতা হস্তগত করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু এর ফলে রাজ্যে এক ধরনের প্রকার সাংবিধানিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে।
অনেকেই এর ফলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন। এটি অবশ্যই খুব বড় বিপদ। নির্বাচিত এই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের সংস্থাগুলি থেকেই জনসাধারণের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতায়নের সুযোগ উন্মোচিত হয়, যার অনুপস্থিতিতে মানুষের সক্রিয়তা, উদ্যোগ, সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটে না এবং সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগমন ব্যাহত হয়।
কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা সম্ভব যে এর থেকেও অনেক বড় বিপদ মমতাদেবীর এই নতুন উদ্যোগে নিহিত রয়েছে। শুধু পঞ্চায়েত নির্বাচনে আটকে না থেকে গত ২৩ মাসের ঘটনাক্রম বিচার করলে এই সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতো সাংগঠনিক সংস্থাকে আক্রমণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ঘটনা হল, যে স্তম্ভগুলির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সেই স্তম্ভগুলি গত ২৩ মাসে, একের পর এক মমতাদেবীর টার্গেট হয়েছে। এই ভাবে একের পর এক আক্রান্ত হয়েছে বিরোধী পক্ষ, সংবাদমাধ্যম এবং খোদ বিচারবিভাগ। এই তালিকার নবতম সংযোজন রাজ্য নির্বাচন কমিশন তথা সংবিধান। ঘটনাগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে না দেখে একযোগে দেখলে, বিচ্ছিন্ন বৃক্ষ না দেখে বৃক্ষরাজিশোভিত অরণ্য চোখে পড়লে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই বিপদের প্রকৃত চেহারা।
আশার কথা একটাই। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যখন সামরিক অভ্যুত্থান, প্রাসাদ চক্রান্ত, ক্যু-দে-তা’তে গণতন্ত্র বিপর্যস্ত, তখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল রয়েছে সমানে। রুপোলি রেখাও একটাই। নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষনের দাপটে একদা যেমন নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কমিশনের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনই হয়তো বা রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডের সৌজন্যে রাজ্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সার্বভৌম ক্ষমতা অবশেষে স্বীকৃত হবে সর্বমহলেই। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা তো এ ভাবেই গড়ে ওঠে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.