পেটেন্ট নিয়ে লড়াইয়ের সূত্রে ‘গ্লিভেক’ নামক ওষুধটি এখন সংবাদের শিরোনামে।
ক্যানসারের চিকিৎসায় কার্যকর এই ওষুধের জন্মবৃত্তান্ত কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই রোমহর্ষক।
দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত |
ক্রনিক মায়ালয়েড লিউকিমিয়া (সি এম এল) নামে এক ভয়ানক ক্যানসারে ব্যবহৃত জীবনদায়ী ওষুধ ‘গ্লিভেক’-এর পেটেন্ট এ দেশে হস্তগত করার জন্য বহুজাতিক কোম্পানি নোভার্টিস দীর্ঘ দিন ধরে এক আইনি লড়াই লড়ছে। ভারতবর্ষে সি এম এল রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ, প্রতি বছর যুক্ত হন প্রায় ২০,০০০ নতুন রোগী। নোভার্টিসের কাছ থেকে ওষুধ কিনলে তাঁদের মাথাপিছু মাসিক খরচ দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। দেশি কোম্পানি এ-ওষুধই বিক্রি করে মাসিক ৮০,০০০ টাকা দরে। ফলে বাণিজ্যিক বিরোধ বাধবেই। প্রায় সাত বছরের মোকদ্দমা-শেষে সুপ্রিম কোর্টে আপাতত নোভার্টিসের হার হয়েছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন নতুন জীবন ফিরে পাওয়া কয়েক লক্ষ সি এম এল রোগী ও তাঁদের পরিবার। এতে যে বিতর্কে দাঁড়ি পড়ল তা অবশ্য নয়। নতুন ভারতীয় পেটেন্ট আইনের (২০০৫) আওতায় গ্লিভেক আদৌ পড়ে কি না, বা সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের এই সিদ্ধান্ত বড় ওষুধ কোম্পানিগুলিকে নতুন ওষুধের গবেষণায় নিরুৎসাহিত করবে কি না, এমন সব সুদূরপ্রসারী বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু সেই তাত্ত্বিক কচকচিতে না গিয়ে আমরা বরং গ্লিভেকের সঙ্গে পরিচয়টা সেরে ফেলি।
গ্লিভেককে চিনতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৯৩-এর গ্রীষ্মে। তার এই বাণিজ্যিক নামকরণটি তখনও হয়নি। রাসায়নিক নাম ‘ইমাটিনিব’-ও খুব একটা পরিচিত নয়। সে তখন CGP57148 এই সাংকেতিক নামে অভিহিত। কখনও কখনও তাকে ST1571হিসেবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের বাসেল-এ সিবা-গাইগি’র গবেষণাগার থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এই ওষুধের একটি প্যাকেট সেই সময় এসে পৌঁছয় পোর্টল্যান্ডে অরিগন হেল্থ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি’র তরুণ গবেষক ব্রায়ান ড্রুকার-এর কাছে।
ড্রুকার পেট্রিডিশে কিছু সি এম এল কোষ নিয়ে তাতে এই ওষুধ প্রয়োগ করলেন। চটপট সাড়া মিলল— ড্রুকারকে হতবাক করে ক্যানসারগ্রস্ত কোষগুলি চটপট মারা পড়ল। ইঁদুরের দেহে কৃত্রিম ভাবে সি এম এল সৃষ্টি করে তার ওপর এই ওষুধ প্রয়োগ করা হল। প্রথম পরীক্ষার মতো এ ক্ষেত্রেও কয়েক দিনের মধ্যে টিউমার চুপসে গেল, কিন্তু ইঁদুরের স্বাভাবিক রক্তকোষ অপরিবর্তিত রইল। এ বার তৃতীয় পরীক্ষা। কিছু সি এম এল আক্রান্ত মানুষের অস্থিমজ্জার নমুনা পেট্রিডিশে নিয়ে ড্রুকার CGP57148 প্রয়োগ করলেন। লিউকিমিয়া কোষ প্রায় তৎক্ষণাৎ মারা পড়ল। ডিশের মধ্যে বেঁচে রইল শুধু স্বাভাবিক রক্তকোষ। বোঝা গেল, গবেষণাগারে ড্রুকার সি এম এল সারাতে পেরেছেন। ‘নেচার মেডিসিন’ পত্রিকায় ড্রুকারের এই পর্যবেক্ষণের কথা প্রকাশিত হল। |
তখনও লড়াই চলছে। নোভার্টিস-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ডিসেম্বর ২০১২। ছবি: এ এফ পি। |
জটিলতা যথাসম্ভব এড়িয়ে এই সাফল্যের প্রেক্ষিতটি সংক্ষেপে বোঝার চেষ্টা করি। কয়েক দশক আগে থেকেই ক্যানসার গবেষকরা অঙ্কোজিনের কথা বলে আসছিলেন, অর্থাৎ যে জিন ক্যানসার সৃষ্টি করে বা তার সৃষ্টিতে সাহায্য করে। স্বাভাবিক কোষের মিউটেশনের ফলে অঙ্কোজিনের সৃষ্টি। ১৯৮০-র দশকে প্রমাণিত হয়, ৯ এবং ২২ নং ক্রোমোজোমের মিউটেশনের ফলে Bcr-abl নামক যে অঙ্কোজিনটি তৈরি হয়, সেটিই সি এম এল-এর কারণ। এই দশকেই বাসেল-এ সিবা-গাইগি’র গবেষণাগারে কাইনেজ নামে এক ধরনের প্রোটিন-এনজাইমের বিভিন্ন রূপ নিয়ে গবেষণা হচ্ছিল, যাতে কোষের বৃদ্ধি মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণকারী কোনও ওষুধ আবিষ্কার করা যায়। যে কয়েক ডজন কাইনেজ আবিষ্কৃত হয়, তার মধ্যে একটি এই CGP57148, যা Bcr-abl’এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার কাজকর্ম রুখে দিতে পারে। এই তাত্ত্বিক সম্ভাবনাকেই হাতে-কলমে প্রমাণ করলেন ড্রুকার। ক্যানসার গবেষণার চরম স্বপ্ন এখানে পূরণ হল, ক্যানসার কোষের অঙ্কোজিনের প্রতি স্থিরলক্ষ্য এমন এক ওষুধ পাওয়া গেল, ক্যানসার কোষকে যা ধ্বংস করে, কিন্তু স্বাভাবিক কোষে আঁচড়টি লাগতে দেয় না।
ড্রুকার আশা করেছিলেন, তাঁর সাফল্যে সিবা-গাইগি উল্লসিত হবে। কিন্তু বাসেল-এ সিবা-গাইগি’র অন্দরমহলে তখন তোলপাড় চলছে। এই কোম্পানি তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ‘স্যান্ডোজ’-এর সঙ্গে মিশে গেছে, তৈরি করেছে ভেষজ শিল্পের অতি ক্ষমতাবান কোম্পানি ‘নোভার্টিস’। তারা অন্য হিসেব কষল। তারা দেখল, CGP57148-কে মানব-চিকিৎসার উপযুক্ত ওষুধ হিসেবে উন্নীত করতে আরও পরীক্ষানিরীক্ষা দরকার পশুর ওপর পরীক্ষা, তার পর মানুষের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। সব মিলিয়ে তার আনুমানিক ব্যয় ১০ থেকে ২০ কোটি ডলার। আমেরিকায় প্রতি বছর সামান্য কয়েক হাজার মানুষ সি এম এল-এ আক্রান্ত হন। তার জন্য এত বিপুল টাকা বিনিয়োগে নোভার্টিস রাজি হল না। নোভার্টিস কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর জন্য ’৯৫ থেকে ’৯৭-এর মধ্যে ড্রুকার বাসেল আর পোর্টল্যান্ডের মধ্যে বার বার ওড়াউড়ি করেছেন। পরিস্থিতিটা অভিনব: গবেষক নিজেই ওষুধ কোম্পানিকে অনুরোধ করছেন, তারা যাতে নিজেদেরই এক উৎপাদনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে।
অবশেষে ১৯৯৮-এর প্রথম দিকে নোভার্টিস টলল। তারা মাত্র কয়েক গ্রাম CGP57148 প্রস্তুত করে মোটামুটি ১০০ জন রোগীর ওপর পরীক্ষণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিল। ড্রুকারের সঙ্গে চার্লস সয়ার্স এবং হিউস্টনের হিমাটোলজিস্ট মোসে তালপাজ এই ট্রায়ালের নেতৃত্ব দিলেন। ১৯৯৮-এর শীতকালের মধ্যে তাঁরা এই ওষুধ প্রয়োগে ডজন কয়েক মরণাপন্ন সি এম এল রোগীর অভাবনীয় নিরাময় প্রত্যক্ষ করলেন।
নতুন এই ওষুধের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। গ্লিভেক যখন বাণিজ্যিক ভাবে প্রস্তুত হচ্ছে, সেই সময়েই ইন্টারনেট-এ জন্ম নিচ্ছে চ্যাট করার ব্যবস্থা। ১৯৯৯ নাগাদ রোগীরা বিভিন্ন খবরাখবর নেট-এ আদানপ্রদান করা শুরু করেন। অনেক ক্ষেত্রে এমন হত, রোগীরাই গ্লিভেক-এর খবর তাঁদের ডাক্তারদের জানাতেন। ডাক্তাররা তখনও সন্দিহান দেখে তাঁরা উড়ে যেতেন অরিগন বা লস অ্যাঞ্জেলেসে, সেখানে গ্লিভেক ট্রায়ালের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজেদের নাম লেখাতেন।
জুন ১৯৯৯ নাগাদ বোঝা গেল, গ্লিভেক সফল। সি এম এল রোগীর চিকিৎসায় গ্লিভেক-ই আদর্শ সাব্যস্ত হল। ক্যানসার চিকিৎসায় সে এক নতুন দরজা খুলে দিল: সুনির্দিষ্ট, পরিকল্পিত ও বিষক্রিয়াহীন নিরাময়ের দরজা। একদা-মারণ সি এম এল সম্পর্কে আলোচনা এখন ‘প্রাক-গ্লিভেক যুগ’ এবং ‘গ্লিভেক-উত্তর যুগ’ হিসেবে ভাগ করা হয়। ড্রুকারের ওষুধ বাজারে আসার আগে সি এম এল-কে এক বিরল ব্যাধি মনে করা হত। নতুন করে সি এম এল-এ আক্রান্ত হওয়ার হার এখনও একই আছে (যেমন, এ দেশে বছরে প্রায় ২০,০০০), কিন্তু গ্লিভেক আসার পর এই রোগে আক্রান্ত জীবিত রোগীর সংখ্যায় এক নাটকীয় পরির্তন এসেছে। ২০০৯ সালের সমীক্ষা অনুসারে, যে সব রোগী গ্লিভেক পাচ্ছেন, রোগ নির্ণয়ের পর তাঁরা গড়পড়তা ৩০ বছর বাঁচেন। ফলে যে রোগ একদা বিরল ছিল, গ্লিভেক তাকে তুলনামূলক ভাবে বহুদৃষ্ট করে তুলেছে। ড্রুকার রসিকতা করে বলেন, তিনি ক্যানসার চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্যটাই গুলিয়ে দিয়েছেন: তাঁর ওষুধ পৃথিবীতে সি এম এল-এর প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে দিয়েছে!
কিন্তু সাফল্যের দীর্ঘস্থায়ী উদ্যাপনে বিজ্ঞানের সায় নেই। গ্লিভেক পরীক্ষণের পঞ্চম বছরে এসে তালপাজ এবং সয়ার্স এমন কিছু সি এম এল রোগীর সম্মুখীন হলেন, যাঁরা গ্লিভেক চিকিৎসায় সাড়া দিলেন না। সংখ্যায় তাঁরা তুলনামূলক ভাবে নগণ্য হলেও বোঝা গেল, গ্লিভেক-উত্তর যুগে অপেক্ষা করে রয়েছে নতুন সংকট, নতুন চ্যালেঞ্জ।
সয়ার্স দেখালেন, সি এম এল কোষ এক অদ্ভুত উপায়ে গ্লিভেক-প্রতিরোধী হয়ে উঠছে: কোষগুলির নতুন এক মিউটেশনে Bcr-abl’এর গঠনগত পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে এমন এক প্রোটিন সৃষ্টি হচ্ছে যেটি লিউকিমিয়ার বাড়বৃদ্ধিতে মদত দিতে পারছে অথচ ওষুধটির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। সাধারণ ভাবে Bcr-abl-এর মাঝ বরাবর এক সঙ্কীর্ণ খাঁজের মধ্যে গ্লিভেক ঢুকে যায়— রসায়নবিদ জন কুরিয়ান-এর ভাষায়, যেন ‘প্রোটিনটির হৃদয়ের মাঝ বরাবর একটা তির গেঁথে’ যায়। গ্লিভেক-প্রতিরোধী মিউটেশন Bcr-abl-এর আণবিক স্তরে এই ‘হৃদয়’কেই বদলে দেয়। তার সামনে গ্লিভেক-এর বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
এই সমস্যার সমাধান ঘটাল ‘ডাসাটিনিব’। এই নতুন ওষুধটির সঙ্গে গ্লিভেক-এর গঠনগত তেমন কোনও সাদৃশ্য নেই। এটি Bcr-abl-এর ‘হৃদয়ে’ পৌঁছচ্ছে তার প্রোটিন স্তরের ভিন্ন এক আণবিক ফাটল দিয়ে এবং রুখে দিচ্ছে গ্লিভেক-প্রতিরোধী সি এম এল-এর দৌরাত্ম্য। গ্লিভেক আবিষ্কারের এক দশকের মধ্যে ক্যানসারের স্থিরলক্ষ্য চিকিৎসায় দু-ডজন নতুন ওষুধ নথিভুক্ত হয়েছে। আরও কয়েক ডজন প্রস্তুতির পথে। ওই সব ওষুধ ফুসফুস, স্তন, বৃহদন্ত্র ও প্রস্টেট ক্যানসারে, সারকোমা, লিম্ফোমা ও লিউকিমিয়ার চিকিৎসায় কার্যকর।
বোঝা যাচ্ছে, গ্লিভেক যে জিন-নির্দিষ্ট স্থিরলক্ষ্য চিকিৎসার দরজা খুলে দিয়েছে সেই পথে সনিষ্ঠ থাকলে সামগ্রিক ক্যানসার যুদ্ধেই আমাদের সাফল্য আসবে। গ্লিভেক আমাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে, আমরা পারি, আমরা পারব।
|
ঋণ: সিদ্ধার্থ মুখার্জি, দ্য এমপেরর অব অল ম্যালাডিজ |