গুমরে থাকা শোক ফুঁসে উঠছে সুরের ভাষায়।
ঘাড়টা সামান্য কাত করে নিজের মনে বেহালায় ছড় টেনে যাচ্ছেন ভেঙেচুরে যাওয়া এক প্রবীণ। কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ঘরের মধ্যে গুটিকয় আত্মীয়-পড়শির অস্ফুট জল্পনা— একটু বিশ্রাম না-নিলে তো উনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন!
কিন্তু প্রয়াত এসএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্তের বাবা প্রণব গুপ্তকে সে কথা কে বোঝাবে? সুরের আশ্রয়ে শান্তি খুঁজে চলেছেন সদ্য পুত্রহারা পিতা। বেহালায় ছড়ে একনাগাড়ে মোচড় দিয়ে চেনা সুর ছড়িয়ে দিচ্ছেন গলির বাতাসে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ কিংবা ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।’
আর তা শুনে বুধবার ভরদুপুরে গড়িয়া স্টেশনের কাছে শ্রীনগরের গমকলে তিনতলা বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া ভিড়টা বিমূঢ় ভঙ্গিতে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। প্রতিবেশীরা বলছিলেন, এমন সুর রোজই ভেসে আসত ওই বাড়ি থেকে। যখন নিয়ম করে বাবার সঙ্গে রেওয়াজে বসত ছেলেটা। সেই ছেলেরই নিথর দেহ কিছুক্ষণ বাদে এসএসকেএমের মর্গ থেকে বাড়ি ফিরবে। পাড়া-পরিজন, পাড়া-পড়শি, বন্ধু, পার্টিকর্মী, সংবাদমাধ্যম তখন তারই প্রতীক্ষায়। এন্টালিতে এসএফআই সদর দীনেশ মজুমদার ভবনেও শোক ও স্মৃতির বিষাদগভীর পরিবেশ। সুদীপ্তের পাড়ায় আশপাশের বাড়িতে সকলের প্রিয় ছেলেটির স্মরণে পোস্টার দিয়েছিলেন বামপন্থীরা। এসএফআই সদরের সামনে বাঁধা হয়েছিল মঞ্চ। সকালে এসএসকেএমের মর্গ থেকে নেতাজিনগর কলেজ, নিউ গড়িয়ায় বাড়ি হয়ে সুদীপ্তকে নিয়ে যাওয়া হয় এন্টালিতে। অকালপ্রয়াত ছাত্রনেতাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাজ্যের প্রথম সারির সিপিএম নেতারা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, গৌতম দেব প্রমুখ। এসএফআইয়ের হয়ে নিয়মিত স্লোগান বাঁধতেন সুদীপ্ত। তাঁর গলার স্বরের রেকর্ডের সঙ্গে স্লোগান দিতে গিয়ে সতীর্থদের কারও কারও গলা বুজে এল কান্নায়।
প্রয়াত বাম ছাত্রনেতাকে অন্তিম শ্রদ্ধা জানাতে এ দিন এসএফআই সদরে যান ছাত্র পরিষদের নেতা রাহুল রায় ও কৌস্তভ বাগচী। কেওড়াতলায় দেহ নিয়ে যাওয়ার আগে লেক মার্কেটের কাছে মরদেহে মালা দেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সুদীপ্তের দেহ নিয়ে শোকমিছিল যখন কেওড়াতলা মহাশ্মশানের দুয়ারে, তখন প্রায় সন্ধে। পথের দু’ধারে অপেক্ষমান জনতা। শেষকৃত্য মিটতে-মিটতে রাত ন’টা গড়িয়ে যায়।
মহানগরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা মিছিলের দীর্ঘ যাত্রাপথ মসৃণ রাখতে প্রশাসনও ছিল তৎপর। মর্গ থেকে দেহ বেরনো ইস্তক কাচে ঢাকা শববাহী গাড়ির সঙ্গী হয় দলীয় সতীর্থদের গাড়ি, মোটরভ্যান, মোটরসাইকেল। কোনও ট্র্যাফিক সিগন্যালে মিছিলের গতি যাতে থমকে না-যায়, পুলিশের সজাগ নজর ছিল সে দিকে। কিন্তু সুদীপ্তের বাড়িতে শোকে বিহ্বল বাবাকে কী ভাবে সামলানো হবে, তা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন দলের তাবড় নেতা-কর্মীরা।
বিকেলে শববাহী গাড়ি গলিতে থামতেই সিপিএমের দুই রাজ্য নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় ও সুজন চক্রবর্তী শশব্যস্ত হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যান। তাঁদের দু’পাশে নিয়ে একটু বাদে বেরিয়ে আসেন প্রণববাবু। আধময়লা সাদা শার্টের পকেটে ছেলের ছবিওয়ালা ব্যাজ সাঁটা। তাতে লেখা ‘কমঃ সুদীপ্ত গুপ্ত লাল সেলাম।’ মরদেহ ঘিরে তখন চরম ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি। ভিড় ঠেলে অনেকেই মোবাইল ফোন বা ক্যামেরায় ছবি তুলতে মরিয়া। তারই মধ্য দিয়ে গিয়ে ছেলের দেহে রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে দিলেন প্রণববাবু। একটু আগে যিনি বলেছেন, ‘পার্থ (সুদীপ্ত) ফিরলেই আমায় ডেকো কিন্তু! ওকে তোমরা পুব দিকে মাথা করে শুইয়ে রেখো। আমি তো দীক্ষিত। ওকে এক বার গুরুর মন্ত্র শোনাতে হবে। অ-নে-ক দূর যেতে হবে ছেলেটাকে!’
বৃদ্ধ এখন ছেলের মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে কী যেন মন্ত্র পড়লেন। দেখে ভিড়ের অনেকে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। কান্তিবাবু-সুজনবাবুরা এতক্ষণ ওঁকে ক্রমাগত বুঝিয়ে গিয়েছেন, ‘আপনি ভিতরে যান, বিশ্রাম নিন।’ কিন্তু এ বার হঠাৎ উনি বলে উঠলেন, ‘আমিও শ্মশানে যাব!’ কোনও মতে নিরস্ত করা হল। শেষযাত্রা বাড়ির উঠোন ছাড়ার আগে প্রণববাবু এক বার শুধু বললেন, ‘আচ্ছা, গড়িয়া শ্মশানে নিয়ে গেলে হয় না! দেড় বছর আগে ওর মাকে তো ওখানেই...।’ কেওড়াতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্যের সিদ্ধান্তটা মঙ্গলবার রাতে অবশ্য প্রণববাবুর সঙ্গে পরামর্শ করেই নিয়েছিলেন সুদীপ্তর বন্ধু, রাজনৈতিক সতীর্থরা। তাঁরা বোঝাতে বৃদ্ধ সম্মতির ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন।
বস্তুত এ দিন সকাল থেকে বাড়ির সকলের দৃষ্টি আটকে প্রণববাবুরই দিকে। একতলার বাঁ দিকের ঘরে বসে নিজের মনে ছেলের স্মৃতিচারণ করছেন, কখনও হাতে তুলে নিচ্ছেন বেহালা। পরিবারের ঘনিষ্ঠ দুই মহিলার আফশোস, ‘এত করে বললাম, একটা ভাতও দাঁতে কাটলেন না!’ কাঁদতে কাঁদতে কথা বলতে গিয়ে বৃদ্ধ হাঁপিয়ে উঠছেন। একটু শান্ত হয়েই ফের সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে একটানা বলে চলেছেন ছেলের কথা।
এবং সুদীপ্তকে নিয়ে শোকযাত্রা পাড়া ছেড়ে বেরোনোর পরেও তাঁর মুখে কথার বিরাম নেই!
পরিচিতেরা বলাবলি করছিলেন, এর পরে যখন এত লোকজন থাকবে না, তখন কী হবে! বাড়িতে সঙ্গী বলতে তো ছিল ওই এক ছেলে। মেয়ে-জামাইও কেঁদে-কেঁদে আকুল! বয়স্ক মানুষটিকে কে কী ভাবে সামলাবে?
পরিজনদের জল্পনা-আশঙ্কার মাঝে ফের ভেসে এল বেহালার সুর। রবীন্দ্রসঙ্গীতে আশ্রয় খুঁজছেন পুত্রহারা বৃদ্ধ। |