কমোডিটি এক্সচেঞ্জ পণ্য বাজারে আলু

ড়াশোনা তো করিস না, বড় হয়ে বাজারে বসে আলু বেচবি। ছোটবেলায় অনেককেই পড়া না-পারলে এই কথাটা শুনতে হয়েছে। কিন্তু সত্যি যে আলু কেনা-বেচা করে লাভের মুখ দেখা যায়, তার সম্ভাবনা হয়তো মনে আসেনি। কিন্তু কথাটা সত্যি। তা-ও সরাসরি বাজার থেকে নয়, আগাম লেনদেনের বাজারে আলুতে লগ্নি করে।

আগাম লেনদেনের শুরু
• পৃথিবী জুড়েই আলু গুরুত্বপূর্ণ একটি ফসল। পশ্চিমবঙ্গেও প্রচুর আলু উৎপন্ন হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই শস্যটির দরের ওঠা-পড়া সামলাতে আলুর আগাম লেনদেন চালুর সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র।
• দু’টি প্রধান কমোডিটি এক্সচেঞ্জকে এই পণ্যের আগাম লেনদেনের অনুমতি দেয় ফরওয়ার্ড মার্কেটস কমিশন (এফএমসি)।
• খুফরি জ্যোতি ও আগরা আলুর আগাম লেনদেন শুরু করে এমসিএক্স। এনসিডিইএক্স চালু করে আগরা আলুর কেনা-বেচা। এখন এনসিডিইএক্স আলুর লেনদেন বন্ধ করেছে। এমসিএক্স শুধুমাত্র আগরা আলুর আগাম লেনদেন করে। আগরা থেকেই যার ডেলিভারি নিতে হয়।

এক্সচেঞ্জে কেনা-বেচা
• আলুর জন্য এক্সচেঞ্জে পণ্যের দাম নির্ধারণ, মার্জিন ভিত্তিক লেনদেন, লগ্নিকারীর গ্যারান্টি ও অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে ব্যবস্থা রাখা হয়।
• আলুর জন্য এমসিএক্সে রয়েছে হিমঘরের ব্যবস্থাও। যেখানে কৃষক বা ব্যবসায়ীরা পণ্য রাখতে পারেন। তাঁরা চাইলে এক্সচেঞ্জ সেই আলুর মান নির্ধারণ করে দেয়। তা নির্দিষ্ট মানের সঙ্গে মিলে গেলে আগাম লেনদেনের কাজে ব্যবহার হয়।
• চুক্তির মেয়াদ শেষে আলু বাধ্যতামূলক ভাবে বাড়ি নিয়ে যেতে হয়। লগ্নিকারী চাইলে চুক্তি শেষের আগে বাজার থেকে লাভের অঙ্ক নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন। ক্ষতি হলে তা পুষিয়ে দিতে হয়।
• কৃষক বা ব্যবসায়ী ছাড়া সাধারণ লগ্নিকারীও এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে পারেন।


ঝুঁকি কমাতে
যেহেতু আলু কৃষি পণ্য এবং সরাসরি মানুষের রোজকার জীবনের সঙ্গে যুক্ত, তাই সরকার ও এক্সচেঞ্জ পণ্যের দামের উপর কড়া নজর রাখে।
• বর্তমানে আলুর দামের গতি উপরের দিকে। তাই পণ্যটি কেনার সময়ে মার্জিন মানি (যে-টাকা প্রথমেই জমা দিতে হয়) বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে এফএমসি। অর্থাৎ ন্যূনতম এক লট (৩০০ কুইন্টল বা ৩০ টন) আলু কিনতে এখন ৩০% টাকা অগ্রিম দিতে হয়। ১ কুইন্টল আলুর দাম ৮৫০ টাকা হলে মোট লগ্নি ২,৫৫,০০০ টাকা। আর প্রথমে দিতে হবে ৭৬,৫০০ টাকা।
• আলু বিক্রির মার্জিন মানি ২০ শতাংশে বেঁধে দিয়েছে এফএমসি।
• আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতেই এত বেশি মার্জিন রাখার পক্ষপাতী এফএমসি। কিন্তু সাধারণ বাজারে এই ব্যবস্থা চালু সম্ভব নয়।
• চুক্তির মেয়াদ শেষে পণ্য বাড়ি নিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ তাদের হিমঘরে রাখা পণ্যের মানের গ্যারান্টি দেয়। কিন্তু যদি বিক্রেতার ভুলে আলুর মান এক্সচেঞ্জের সঙ্গে না-মেলে, তখন তাঁকে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়। সেই টাকার অংশ ক্রেতাকে দেওয়া হয়।

দামের বাড়া-কমা
• বীজের মান খারাপ হলে কিন্তু আলুর ফলন খারাপ ও আকার ছোট হয়। সে ক্ষেত্রে মার্চে ফসল ওঠার পর আলুর দাম বাড়তে পারে।
• সাধারণত আলুর বীজ বপন শুরু হয় ডিসেম্বর মাসে। শীতকালীন বৃষ্টি, ধসা রোগ ইত্যাদি আলুর দাম ও চাষের জমির পরিমাণ নির্ধারণে বড় ভূমিকা নেয়। লগ্নিকারী এপ্রিলের আগাম লেনদেন চুক্তির আগে এগুলি মাথায় রাখলে মুনাফা করতে পারেন।
• এপ্রিলের পর থেকে বছরের শেষ লেনদেন চুক্তির (সাধারণত নভেম্বর) ক্ষেত্রে সারা বছরে পণ্যটির চাহিদা এবং কেন্দ্র-রাজ্যের বিভিন্ন নীতি এর দাম স্থির করতে সাহায্য করে।
• মার্চ-এপ্রিলে সাধারণত ফসল ওঠে এবং হিমঘরে আলু যায়। ফলে এই সময়ে আলুর দামে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা দেখা যায়।
• অন্যান্য রাজ্য বা দেশে রফতানির উপরেও দাম নির্ভর করে।

লাভ-ক্ষতির হিসাব
• এই বাজারে কুইন্টল পিছু দরে আলুর দাম হিসাব হয়।
• পণ্যটির টিক সাইজ ১০ পয়সা। লাভ-ক্ষতি হিসাবের সময়ে যা কাজে আসে। দাম সব সময়ে টিক সাইজের গুণীতকে বাড়ে-কমে। কিন্তু ভগ্নাংশ হয় না। আলুর ক্ষেত্রে তা কুইন্টলে ১০ পয়সার কম হবে না।

কৃষকদের বিমা
আগাম পণ্য লেনদেনের এই বাজার চাষিদের বিমা হিসেবেও কাজ করে।
ধরা যাক, চাষি দাম বাড়ার আশায় আলু বিক্রি না-করে হিমঘরে রেখেছেন। খোলা বাজারে মরসুম শেষে (সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর) জোগান বাড়ায় দাম পড়ে গেল। ফলে তিনি ক্ষতির মুখে পড়লেন।
এ বার ধরে নিই সেই আলু তিনি অক্টোবরে কুইন্টলে ১,০০০ টাকায় বিক্রি করবেন বলে এক্সচেঞ্জে চুক্তি করেছেন। দেখা গেল সত্যি সত্যিই অক্টোবরে দাম কুইন্টলে ৫০০ টাকায় নেমে এসেছে। কিন্তু আগে থেকে চুক্তি থাকায় লেনদেনের বাজারে তাঁর ইতিমধ্যেই ৫০০ টাকা লাভ হয়েছে (১,০০০-৫০০=৫০০ টাকা)। তখন চুক্তির মেয়াদ ফুরনোর আগেই এক লট আলু বিক্রি করে দিলে তাঁর লাভ হবে ৩০০x৫০০=১,৫০,০০০ টাকা।
দর বাড়লেও কিন্তু তাঁর ক্ষতি হবে না। ধরা যাক আলুর দর কুইন্টলে ১,১০০ টাকা দাঁড়িয়েছে। কিন্তু চাষির চুক্তি রয়েছে আগের মতোই ১,০০০ টাকার। তিনি সেই আলু চুক্তির শেষ দিন পর্যন্ত রেখে দিলে পণ্য বাজারে তাঁর লাভ হবে না। কিন্তু আলু বাড়ি নিয়ে গিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করলে তাঁর (১,১০০-১,০০০)= ১০০ টাকা লাভ হবে।
আগাম লেনদেনের বাজার ছাড়াও হিমঘরের রসিদের মাধ্যমে সাধারণ বাজারে আলু কেনা-বেচা করা হয়। যার পোশাকি নাম ‘আলু বন্ড’। পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গাতেই এই ভাবে লেনদেন হয়। এই বন্ডের কিছু অসুবিধা রয়েছে। তা ছাড়া, ঝুঁকিও অনেকটাই বেশি।

আলু বন্ড কী?
কৃষক বা অন্য কেউ ফলনের পর পণ্য কোনও হিমঘরে রাখলেন। এ জন্য হিমঘর মালিকের কাছ থেকে তিনি রসিদ নিলেন। ধরা যাক তিনি ১০ কেজি আলু হিমঘরে রেখেছেন। চাইলে তিনি ১০ কেজির জন্য একটি মাত্র রসিদ তৈরি করাতে পারেন বা পাঁচ কেজি হিসাবে দু’টি রসিদ তৈরি করাতে পারেন। এ বার তিনি বাজারে রসিদগুলি বিক্রি করে দিলেন। এ ভাবে রসিদগুলি অনেক হাত ঘুরতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী, যাঁর রসিদ, তাঁরই পণ্য। যাঁর হাতে রসিদ থাকবে, তিনি চাইলে হিমঘর থেকে পণ্য বার করে নিতে পারেন।

বন্ডের বৈশিষ্ট্য
• সাধারণত বছরের এই সময়টাতেই (মার্চ-এপ্রিল) বাজারে আসে এই ধরনের আলু বন্ডগুলি।
• মেয়াদ শেষ হয় পুজোর আগে আগে। লগ্নিকারীরা পুজোর মুখে দাম বাড়বে ধরে নিয়েই বিনিয়োগ করেন, যাতে লাভ ঘরে তুলতে পারেন।

বন্ডের ত্রুটি
• দাম হঠাৎ করে কমে গেলে ক্রেতা পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। তখন বিপুল পরিমাণ আলু হিমঘরে পড়ে থাকে, বা বাড়ি নিয়ে যেতে হয়।
• শুধুমাত্র একটি রসিদই পুরো লেনদেনটি পরিচালনা করে। ফলে দাম বেশি পড়ে গেলে সেই রসিদটি যার কাছে থাকে, তাঁকে বড় লোকসানের মুখে পড়তে হয়।
• এই ধরনের বন্ডগুলিতে তৃতীয় কোনও ব্যক্তির (যেমন এক্সচেঞ্জ) গ্যারান্টি থাকে না। তাই ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে কোনও ঝামেলা হলে তার সমাধান করা মুশকিল হয়।
• এমনকী দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও অনেক সময়ে ত্রুটি থেকে যায়। যে-কারণে বাজারে এখনও আলুর দামের ওঠা-পড়া খুব বেশি।
• চাষির আলাদা সুবিধা নেই।

আলু বৃত্তান্ত
কবে কিনবেন সাধারণত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরে
ন্যূনতম পরিমাণ ৩০০ কুইন্টল (৩০ টন)
দাম (৯০০ টাকা প্রতি কুইন্টল) ২,৭০ ,০০০ টাকা
বিক্রির সময়ের মার্জিন প্রায় ৩০% (বর্তমানে)
কেনার সময়ের মার্জিন প্রায় ২০% (বর্তমানে)
টিক সাইজ ১০ পয়সা
ডেলিভারি চুক্তির মেয়াদ শেষে পণ্য হাতে নেওয়া বাধ্যতামূলক।

লেখক এমসিএক্স স্টক এক্সচেঞ্জ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট (মতামত ব্যক্তিগত)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.