|
|
|
|
|
|
নিজের তথ্যভাণ্ডার |
আপনিই চিত্রগুপ্ত
কাছের মানুষ কষ্টে জমানো টাকার হদিস জানেন না বলেই ব্যাঙ্কে
পড়ে থাকে দাবিহীন টাকা। দেখবেন, আপনার সঞ্চয়ও যেন
গুপ্তধন
না-হয় লিখছেন অমিতাভ
গুহ সরকার |
|
|
সমাজে যথেষ্ট সম্মান পাওয়া যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এমন একটি পদে শেষ দিকে কাজ করতেন অনন্তবাবু। বড় পৈতৃক বাড়ি থাকায় নতুন করে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার প্রয়োজন হয়নি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয়ের বেশির ভাগটাই সঞ্চয় করেছেন নানা প্রকল্পে। আত্মীয়, বন্ধু এবং পরিচিত এজেন্টদের পীড়াপীড়ি সামলাতে না-পেরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও লগ্নি করতে হয়েছে বেশ কিছু প্রকল্পে। ছোট থেকে মাঝারি মাপের বিমা পলিসি নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি। ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখায় লকারও খোলা হয়েছে একাধিক। আমানত আছে বিভিন্ন শাখায়। আছে সেভিংস অ্যাকাউন্ট। কম করে ৪/৫টি।
অনন্তবাবু কিন্তু অনন্তকাল বেঁচে থাকেননি। বিদায় নিতে হয়েছে হঠাৎই। রাতদুপুরে বুকে ব্যথা। ভোরে নার্সিং হোম। দুপুরের মধ্যে সব শেষ। প্রাথমিক শোক কাটার পরে প্রশ্ন উঠল, শ্রাদ্ধশান্তির টাকা কোথায়? এ বার সংসারই বা চলবে কী ভাবে! কোথায় আছে সঞ্চয়ের টাকা? কে বা কারা তার নমিনি? বিমা পলিসিগুলিই বা কোথায়! সেখান থেকেও তো কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এ সব প্রশ্নের কোনও উত্তর জানা নেই পরিবারের সদস্যদের।
কারণ দু’টি। এক, টাকাকড়ির ব্যাপারটি অনন্তবাবু একাই সব সময়ে পরিচালনা করেছেন। অন্য কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। দুই, কোনও একটি জায়গায় লিখে রাখেননি সব তথ্য। ফাইলবন্দি করা হয়নি লগ্নি সম্পর্কিত সব কাগজপত্র। এই সব করতে হবে, তা যে অনন্তবাবু ভাবেননি, সেটা নয়। যখনই মনে পড়েছে তখনই ভেবেছেন কাল করব। সেই ‘কাল’ কিন্তু আর আসেনি।
আসলে অন্য অনেকের মতো অনন্তবাবুও ভেবেছিলেন, অন্য সবাই চলে গেলেও তিনি দীর্ঘ দিন থেকে যাবেন। সুতরাং এত তাড়া কীসের! ফলে কিছুই গুছিয়ে রাখা হয়নি। জানিয়ে যাওয়া হয়নি অনেক তথ্য। ফলে পরিবার এখন অথৈ জলে। শত চেষ্টাতেও সব তথ্য উদ্ধার সম্ভব নয়।
কাল্পনিক এই গল্প থেকে কী শিক্ষালাভ হল? অর্থকড়ির তথ্য গুছিয়ে লিখে না-রাখলে সবই অনর্থ। অর্থাৎ সময় থাকতে ব্যবস্থা নিতে হবে। |
তৈরি করুন তথ্যভাণ্ডার |
মজবুত একটি ডায়েরি সংগ্রহ করুন। নাম দিন ‘মাই ইনফোবুক’। বেশ কয়েকটি পরিচ্ছেদে ভাগ করুন ডায়েরিটিকে। এগুলি হল ব্যক্তিগত তথ্য, স্বাস্থ্যের তথ্য, বিনিয়োগ, ব্যাঙ্কিং, বিমা, ঋণ, গাড়ি, বাড়ি, আয়কর, পেনশন, ব্যবসা, উইল ইত্যাদি। আসুন প্রত্যেকটি বিষয় একটু আলাদা করে দেখে নেওয়া যাক।
ব্যক্তিগত তথ্য: নামের থেকে মানুষ এখন সংখ্যা দিয়ে বেশি পরিচিত। এই বিভাগে লিখুন নিজের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, প্যান, পাসপোর্ট, ভোটার আই ডি কার্ড নম্বর, ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত সব তথ্য। কোনও নম্বরের প্রয়োজন হলে কার্ড বার না করলেও চলবে। ডায়েরি থেকে দেখে নিলেই হল। হারিয়ে গেলে ডুপ্লিকেট বার করতেও সুবিধা হবে। লিখে রাখতে পারেন প্রফেশনাল মেম্বারশিপ, ক্লাব মেম্বারশিপ এবং চাকরি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সমস্ত নম্বরও।
স্বাস্থ্যের তথ্য: স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ধরে রাখুন এই বিভাগে। উচ্চতা, ওজন, ব্লাড গ্রুপ, ব্লাড সুগার, প্রেশার ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিখে রাখুন এখানে। পরিবর্তনশীল তথ্য লিখুন পেন্সিলে। পাশে তারিখ লিখতে ভুলবেন না। সময়ে সময়ে পুরনো তথ্য সরিয়ে নতুন তথ্য লিখুন।
লগ্নি-খাতা: লগ্নির যাবতীয় তথ্য রাখুন এই বিভাগে। আলাদা পাতা খুলুন ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্প, ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট, মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড, ডিবেঞ্চার, শেয়ার, কোম্পানি জমা ইত্যাদি তথ্য লিখে রাখার জন্য। মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ লিখে রাখলে সময় মতো রিনিউ করা যাবে। লগ্নি সংক্রান্ত কাগজ যত্রতত্র ছড়িয়ে না-রেখে লগ্নির ক্ষেত্র অনুযায়ী স্তরে স্তরে ফাইলবন্দি করুন। একটি তালিকা রাখুন ফাইলের উপরে। যে-সব লগ্নি ভাঙানো হয়ে গিয়েছে, সেই সংক্রান্ত কাগজ অন্যত্র সরিয়ে ফেলুন। কেটে দিন লগ্নি-খাতা থেকে। না-হলে পরে সংশয় হতে পারে।
ব্যাঙ্কিং: এখানে লিখুন সব সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিশদ তথ্য, ফিক্সড ডিপোজিটের তথ্য, লকার, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ডের নম্বর এবং সাঙ্কেতিক ভাষায় তাদের ‘পিন’ এবং পাসওয়ার্ড। ব্যাঙ্কের লকারে যা যা রাখা আছে, তার একটি তালিকা রাখুন বাড়িতে।
বিমা: জীবনবিমা এবং স্বাস্থ্য বিমা পলিসির সব তথ্য লিপিবদ্ধ করুন এই বিভাগে। পলিসি কোথায় রাখা আছে তাও লিখুন এখানে। লিখে রাখতে হবে মেডিক্লেম রিনিউ করার তারিখ এবং জীবনবিমার মেয়াদ পূর্তির দিন। লেখা থাকবে নমিনির নামও।
গাড়ি: গাড়ির নম্বর, কেনার তারিখ, শেষ কবে সার্ভিস করা হয়েছে, দূষণ সার্টিফিকেটের মেয়াদ ফুরনোর তারিখ, ড্রাইভারের ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর, ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর, ইঞ্জিন অয়েল শেষ বার পাল্টানোর তারিখ, টায়ার এবং ব্যাটারির তথ্য এই বিভাগে লিখে রাখলে বড় সুবিধা হবে। একই ভাবে লিখে রাখা যায় বাইক এবং স্কুটার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য। |
|
ঋণের খাতা: গৃহঋণ, গাড়িঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ-সহ সব রকম ঋণ, ইএমআই, সুদের হার, ঋণের মেয়াদ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করুন এই বিভাগে।
আয়কর বিভাগ: লিখে রাখুন নিজের প্যান, আয়কর দফতরের ওয়েবসাইটে নিজের রেজিস্ট্রেশন আই ডি এবং পাসওয়ার্ড। অ্যাসেসমেন্ট ইয়ার অনুযায়ী লিখুন রিটার্ন ফাইল করার তারিখ এবং অ্যাসেসমেন্ট অর্ডার পাওয়ার তথ্য। থাকবে রিফান্ড সম্পর্কিত তথ্যও। আয়কর সংক্রান্ত কাগজ রাখার জন্য একটি আলাদা ফাইল রাখতে ভুলবেন না।
সম্পত্তি: বাড়ি/ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন নম্বর এবং তারিখ, পুরসভার অ্যাসেসি নম্বর, করের তথ্য ইত্যাদি লিখে রাখতে হবে এই বিভাগে। লিখে রাখতে হবে দলিল কোথায় রাখা আছে, লকারে থাকলে একটি কপি যেন বাড়িতে থাকে। শেষ কবে রং এবং মেরামতি করা হয়েছে, তাও লিখে রাখা যেতে পারে এখানে।
পেনশন: অবসরপ্রাপ্ত মানুষেরা লিখে রাখুন পেনশন সংক্রান্ত সব তথ্য। যাতে চাইলেই তা হাতে আসে।
ব্যবসার তথ্য: যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁরা লিখে রাখুন সেই সম্পর্কিত সব তথ্য। লিখে রাখতে হবে ট্রেড লাইসেন্স, সেলস ট্যাক্স/ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, প্যান ও ট্যান, প্রফেশনাল ট্যাক্স, শপস অ্যান্ড এস্টাবলিশমেন্ট আইন, সার্ভিস ট্যাক্স, রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত তথ্য।
উইল: সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে প্রোমোশনের পর প্রয়োজন মনে করলে একটি উইল তৈরি করে রাখতে পারেন। প্রয়োজন একটি স্ট্যাম্প পেপার এবং দু’জন সাক্ষীর নাম-ধাম। |
জানিয়ে রাখুন |
ডায়েরিটি প্রথমে লিখতে বেশ খানিকটা সময় ব্যয় করতে হবে। এর পর মাসে এক ঘণ্টা সময় দিলেই হবে নতুন তথ্য লেখার জন্য। নিজের সব থেকে কাছের মানুষকে জানিয়ে রাখুন এই ডায়েরির অস্তিত্ব। যাঁরা কম্পিউটারে তথ্য রাখতে বেশি পছন্দ করেন, তাঁরা একই ভাবে হার্ডডিস্কে ধরে রাখতে পারেন প্রয়োজনীয় সব তথ্য। ওই তথ্য সংবলিত একটি সিডি রাখুন বাড়িতে।
বহু মানুষ এই ভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করে যান না বলে তাঁদের সম্পত্তির অনেকটাই যাঁদের জন্য রাখা, তাঁরা হদিসই পান না। এই কারণে ব্যাঙ্কগুলিতে পড়ে আছে কয়েক হাজার কোটি টাকার দাবিহীন জমা। একই ভাবে কোম্পানিগুলিতে পড়ে আছে পাহাড়প্রমাণ দাবিহীন ডিভিডেন্ড। অনন্তবাবু তাঁর পরিবারের জন্য অনেক কিছুই রেখে গিয়েছেন, কিন্তু হদিস দিয়ে যাননি। ফলে সম্পদের পরিবর্তে তাঁরা পেয়েছেন অনন্ত সমস্যা। গুপ্তধন খোঁজার মতো আজও তাঁরা খুঁজে চলেছেন। |
লেখক ম্যাকলিওড রাসেল ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোম্পানি সেক্রেটারি (মতামত ব্যক্তিগত) |
|
|
|
|
|