বাজেট বিশ্লেষণ ভিতের উপর করের বোঝা

০১৩-’১৪ অর্থবর্ষের বাজেট থেকে আমি-আপনি কী পেলাম বা পেলাম না, আজ ফের তার হিসেব কষতে বসেছি। এটা করতে গিয়ে আগের বার আয়কর এবং আরও কিছু প্রত্যক্ষ করের কথা বলেছি। তেমনই এই পর্বে বলব স্থাবর সম্পত্তির (জমি বা বাড়ি) উপর করের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী যে-সব পরিবর্তন আনলেন, তার খুঁটিনাটি। যাঁরা আগামী দিনে ফ্ল্যাট, বাড়ি বা জমি কেনা-বেচার কথা ভাবছেন, তাঁদের যথেষ্ট চাপে ফেলতে পারে এ বারের প্রস্তাবগুলি। চলুন দেখি চিদম্বরম সাহেবের রাজকোষ ভরার তাগিদে কতটা ‘মাসুল গুনতে’ হতে পারে আমাকে-আপনাকে।

ফ্ল্যাট কেনার খরচ বাড়ল
এ বারের বাজেটে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব, কোনও স্থাবর সম্পত্তির (ফ্ল্যাট/বাড়ি/জমি) ক্ষেত্রে তার স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্যায়ন যদি বিনিময় মূল্য (দলিলে দেওয়া মূল্য) থেকে অন্তত ৫০ হাজার টাকা বেশি হয়, তবে ওই বাড়তি অথর্ ক্রেতার (কোনও ব্যক্তি বা হিন্দু অবিভক্ত পরিবার) অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত করযোগ্য আয় হিসেবে ধ রা হবে। তাই তা ওই ব্যক্তির আয়ের সঙ্গে যোগ করে প্রদেয় কর হিসাব হবে। ৫৬(২) ধারায় এই নয়া বিধি কার্যকর হবে। তবে মনে রাখবেন, দুই মূল্যের পার্থক্য ৫০ হাজার টাকা না-ছাড়ালে কিন্তু ক্রেতার আয়করে কোনও পরিবর্তন হবে না।

উদাহরণ
ধরুন আপনি ৩০ লক্ষ টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট কিনলেন। কিন্তু সেই ফ্ল্যাটের স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্যায়ন দেওয়া হল ৫০ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ দু’টি মূল্যের ফারাক থাকছে ২০ লক্ষ টাকা। ফলে এই টাকা করযোগ্য। সে ক্ষেত্রে ওই ২০ লক্ষ টাকা আপনার আয়ের সঙ্গে যোগ হবে। এবং সেই মোট আয়ের উপর কর দিতে হবে। যদি ধরে নিই যে আপনার আয় বছরে ৫ লক্ষ টাকা। তা হলে ২০ লক্ষ টাকা তার সঙ্গে যোগ করলে দাঁড়াবে ২৫ লক্ষ টাকা। এবং ওই ২৫ লক্ষ টাকার উপরেই কর দিতে হবে আপনাকে। ১ এপ্রিল থেকেই কার্যকর হয়েছে এই পরিবর্তন।

অভিযোগ
প্রস্তাবিত এই বিধি ফ্ল্যাট, বাড়ি ও জমি ক্রেতাদের সমস্যায় ফেলবে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের আশঙ্কা। কারণ মূল্যবৃদ্ধির এই জমানায় দাঁড়িয়ে নিজস্ব সম্পদ তৈরি করতে গেলে সাধারণ মানুষকে এ বার গাঁটের কড়ি গুনতে হবে অনেকটাই বেশি। সংশ্লিষ্ট মহল ইতিমধ্যেই দাবি তুলেছে যে, স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্য ও ক্রয়মূল্যের ফারাক যদি ২০% পর্যন্ত হয়, তবে কেন্দ্রের করছাড় দেওয়া উচিত।


মুদ্রার অন্য পিঠ
বোঝাই যাচ্ছে, এখানে ক্রেতার লোকসানের পাল্লা ভারী। তবে তারই মধ্যে এক ঝলক আলো দেখিয়েছে স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্যায়নের দিন নির্ধারণ সংক্রান্ত সুবিধা। সেটা হল, ফ্ল্যাট বা জমি কিনতে চুক্তি সই করার দিন ধরেই আয়কর হিসাবের জন্য স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্যায়ন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন অনেক পরে হলেও সম্পত্তির দামে পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে না তার স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্যের উপর।
আসলে আমরা জানি, সময় যত এগোয়, সাধারণত স্থাবর সম্পত্তির দাম তত বাড়তে থাকে। কাজেই এখানে দামের বিষয়টি রেজিস্ট্রেশনের দিন থেকে না-ধরে, আগে হওয়া চুক্তি সইয়ের দিন থেকে ধরায় ওই ক’দিনের দাম বাড়ার জন্য বাড়তি করের বোঝা বওয়ার দায় নিতে হবে না ক্রেতাকে।
তবে এই সুবিধা পাওয়ারও কিছু শর্ত আছে। কারণ, এই সুযোগ তাঁরাই পাবেন, যাঁরা চুক্তি সইয়ের আগেই ড্রাফট বা চেকে পুরো দাম বা তার একাংশ বিক্রেতাকে মেটাবেন। তবে নগদে টাকা দিলে কিন্তু এই সুবিধা পাওয়া যাবে না।
দান বা উপহারে নিয়ম একই ওই ৫৬(২) ধারা অনুযায়ী দান বা উপহারের ক্ষেত্রে অবশ্য করের কোনও হেরফের ঘটেনি। বিনিময়ে কোনও কিছু না দিয়ে (দান বা উপহার হিসেবে) যদি কারও কাছ থেকে কোনও স্থাবর সম্পত্তি (বাড়ি, ফ্ল্যাট বা জমি) এক জন ব্যক্তি বা একটি হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের হাতে আসে, এবং তার স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্যায়ন ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়, তবে ওই মূল্য সেই ব্যক্তি বা পরিবারের আয় হিসেবে ধরা হয়। এবং স্বাভাবিক ভাবেই তার উপর কর দিতে হয়। অর্থাৎ স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্য ৫০ হাজার টাকা ছাড়ালে, তবেই কর দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে।
তবে কোনও কোনও দান বা উপহারে এই আইন প্রযোজ্য হয় না। যেমন—
• কোনও ‘আত্মীয়ের’ কাছ থেকে দান হিসেবে পাওয়া সম্পত্তি।
• বিয়ের সময়ে পাওয়া উপহার।
• উইল অনুযায়ী হাতে আসা প্রাপ্তি।
• উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি।

চিন্তা বাড়াচ্ছে উৎসে কর
কৃষিজমি ছাড়া ৫০ লক্ষ টাকা বা তার বেশি দামের অন্য যে-কোনও স্থাবর সম্পত্তি কিনলে এ বার ক্রেতা দাম মেটানোর সময়ে ১৯৪আইএ ধারায় ১% হারে উৎসে কর (ট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাট সোর্স বা টিডিএস) কাটা হবে। অবশ্য ওই হস্তান্তর আগামী ১ জুন বা তার পরে হলে, তবেই এই নিয়ম প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে এক লপ্তে মোট দামের উপর টিডিএস কাটাতে হবে না। তার পরিবর্তে বিক্রেতাকে যত বার ক্রেতা টাকা মেটাবেন (তা সে নগদ, চেক, ব্যাঙ্ক ড্রাফট কিংবা অন্য যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন), তত বার তখনই টিডিএস কাটা হবে ১% করে। অর্থাৎ বিক্রেতার হাতে প্রতি কিস্তিতে আসা টাকার থেকে ওই ১% জমা পড়বে সরকারের ঘরে।

কিন্তু ধন্দ...
তবে এখানে একটি বিষয় নিয়ে কিছুটা ধন্দ রয়েছে। কারণ অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার করে দেননি যে, এ ক্ষেত্রে সম্পত্তির দাম তার বিনিময় মূল্য (চুক্তিপত্রে উল্লিখিত বিক্রয়মূল্য) হিসেবে ধরা হবে, না কি তা স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্যায়ন হতে হবে।
২০১২-র বাজেটেও এই একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। কার্যকর না-হলেও, সে বছর কিন্তু স্পষ্ট বলা হয়েছিল ওই ৫০ লক্ষ টাকার সীমা স্থাবর সম্পত্তির স্ট্যাম্প ডিউটির ভিত্তিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া, আগামী দিনে অর্থমন্ত্রীকে এটাও স্পষ্ট করে জানাতে হবে, উৎসে যখন কর কাটার বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে, তখন ক্রেতার ট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাকাউন্ট নম্বর বা ট্যান নেওয়ার দরকার আছে কিনা। জানাতে হবে, তাঁকেও চলতি নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময় অন্তর টিডিএসের স্টেটমেন্ট জমা দিতে হবে কি না। এ সব নিয়ে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু তা যদি না-হয়, তা হলে টিডিএস যে কাটা হল, তার প্রমাণ থাকবে কী করে? আর প্রমাণ না- থাকলে, সম্পত্তি বিক্রেতা ওই টিডিএস-এর সুবিধাটা পাবেন কী করে? সে ক্ষেত্রে সম্পত্তি বিক্রি থেকে বিক্রেতার যে-আয় হল, সেটার উপর কর হিসাবের সময়ে ওই ১ শতাংশকেও ধরা হবে। যা আসলে সরকারের ঘরে গিয়েছে, তাঁর নয়।
আরও একটা বিষয় জেনে রাখুন, সম্পত্তি বিক্রেতার যদি প্যান নম্বর না- থাকে, তা হলে কিন্তু ২০% টিডিএস কাটা হবে এ বার থেকে।
আরও একটি বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করা হয়নি। গত বার বাজেটে বলা হয়, টিডিএস মিটিয়েছেন কি না সেই প্রমাণ না-দেখে রেজিস্ট্রি অফিসে বাড়ি বা জমির দলিল রেজিস্ট্রি করা হবে না। কিন্তু এ বার সে ভাবে নির্দিষ্ট করেও কিছু বলা হয়নি।


প্রোমোটারদের গেরো
এ বারের বাজেট ফ্ল্যাট বা বাড়ির ক্রেতাদের উপর যেমন খুব একটা সদয় হয়নি, তেমনই প্রোমোটার বা বাড়ি/ফ্ল্যাট নির্মাতারাও যে খুব সুখে থাকবেন, তা নয়। নতুন ধারা ৪৩সিএ-তে বলা হয়েছে, ওই সম্পত্তি, মানে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের বিনিময় মূল্য যদি স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্যের থেকে কম হয়, তা হলে ওই স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্যকেই প্রোমোটারের তরফে বিক্রয়মূল্য হিসাবে ধরা হবে। এবং তার উপর তাঁকে কর দিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল, ওই স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্য তো প্রোমোটারের সত্যিকারের আয় না-ও হতে পারে। কারণ তিনি কম দামে ফ্ল্যাট বা বাড়িটি বেচে থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রকৃত আয়ের উপর এখানে করের অঙ্ক হিসাব করা হচ্ছে না।
তবে প্রোমোটারদের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব এ বার দেওয়া হলেও, সাধারণ করদাতাদের ক্ষেত্রে ৫০সি ধারা অনুযায়ী এ নিয়ম আগে থেকেই আছে। তাঁদের কোনও স্থাবর সম্পত্তি থাকলে সেটিকে মূলধনী বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। এবং তার উপর মূলধনী লাভকর (ক্যাপিটাল গেইন্স ট্যাক্স) দিতে হয় স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্য অনুযায়ী। কিন্তু প্রোমোটারদের ক্ষেত্রে এত দিন তা দিতে হত না। কেন্দ্র মূলধনী লাভকর থেকে আয় বাড়াতেই তাঁদের এর আওতায় আনল।

শাঁখের করাত
দু’দিক থেকেই জাঁতাকলে পড়তে চলেছেন সেই ক্রেতাই। বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, এক দিকে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে তাঁদের পকেট আগের তুলনায় বেশি ফাঁকা করতে হবে। অন্য দিকে আবার প্রোমোটারদের ঘাড়ে চেপে বসা বাড়তি করের বোঝাও বইতে হতে পারে তাঁদের।

কৃষিজমি বিক্রি করে আয়
আপনার যদি কৃষিজমি থাকে এবং সেটা যদি বিক্রি করতে যান, তা হলে একটু সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বাজেটে বলা হয়েছে, কৃষিজমি যদি
(১) ১০ হাজার থেকে ১ লক্ষের মধ্যে জনসংখ্যা সম্বলিত পুর এলাকা থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে হয়
(২) ১ থেকে ১০ লক্ষ জনসংখ্যা সম্বলিত পুর এলাকা থেকে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে হয়, তা হলে তা বেচতে গেলে এ বার মূলধনী লাভকর দিতে হবে। এত দিন ওই দূরত্ব ৮ কিলোমিটার হলে কর দিতে হত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.