পঞ্চায়েতে মহিলা সংরক্ষণ
আঁক-সই করে জেলে, ভোটে দাঁড়াতে চান না মেয়েরা
দু-মাস জেল খেটে সম্প্রতি বেরিয়েছেন সেরি বিবি। লাভপুরের দাঁড়কা পঞ্চায়েতের প্রধান তিনি, তাঁর দল সিপিএম। তাঁর বিরুদ্ধে সম্প্রতি পুকুর কাটার দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের হয়। অক্ষর-পরিচয়হীন সেরি বিবির সই ছিল সরকারি কাগজপত্রে, তাই জেল খাটতে হল তাঁকে। কিন্তু তাতেই ভোগান্তি হয়নি। সম্প্রতি এক ঠিকাদারকে বেআইনি ভাবে বেশি টাকা পাইয়ে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। তার জেরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে সেরি বিবিকে।
কপালজোরে হাজতবাস এড়িয়েছেন প্রতিমা বাগদি। ময়ূরেশ্বরে দাসপলশা পঞ্চায়েতে তফসিলি মহিলা প্রধান পদে তিনি বসেন বিজেপির প্রার্থী হয়ে। তাঁর বিরুদ্ধেও ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ করে ব্লক প্রশাসন। কোনও মতে উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন পেয়েছেন তিনি।
মহিলাদের মধ্যে সাক্ষরতার প্রসার প্রায় বন্ধ। তাই ঝুঁকি বাড়ছে পঞ্চায়েতে নির্বাচিত মেয়েদের।
পড়াশোনা না-জানায় গত পাঁচ বছর ধরে প্রধানের কাজকর্ম সামলাতে গিয়ে এমনই ঝুঁকির মুখে পড়েছেন বহু মহিলা। দলের লোকদের কথা শুনে প্রতিমা বাগদি, সেরি বিবির মতো মেয়েরা যেখানে-সেখানে সই করে ফেঁসেছেন দুর্নীতির মামলায়। দরিদ্র, নিম্নবর্ণ, আদিবাসী পরিবারগুলির বহু মেয়ে তাই আর ভোটের ময়দানে থাকতে চাইছেন না।
অবস্থা এমনই যে, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে ৫০ শতাংশ মহিলা সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী খুঁজতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে রাজনৈতিক দলগুলি। বিজেপির ময়ূরেশ্বর ব্লক কমিটির সভাপতি তামাল মণ্ডল, সিপিএমের দাসপলশা লোকাল কমিটির সদস্য মহম্মদ মকরম আলি, সিপিএমের লাভপুর জোনাল কমিটির সদস্য রমেশ চট্টোপাধ্যায় জানান, স্বল্প-শিক্ষিত মহিলা প্রধানরা প্রায়ই আইনি জটিলতায় জড়িয়ে যান, তাই এ বারে অনেকে আর প্রার্থী হতে চাইছেন না।
তফসিলি, আদিবাসীদের জন্য পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান বা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতিদের পদ সংরক্ষিত থাকে। রাজনৈতিক দলগুলি যাঁদের প্রার্থী করে, তাঁদের অধিকাংশই শুধুমাত্র নিজেদের নামটুকু লিখতে পারেন। অনেকেই আবার ভোটে জয়ী হওয়ার পর পঞ্চায়েত বা দলীয় কর্মীদের কাছ থেকে পদবি-সহ নিজের নামের আদ্যাক্ষর ছবি আঁকার মতো করে রপ্ত করেন। চেক লিখতেও ওই জাতীয় ‘আঁক সই’ দেন তাঁরা। প্রশাসনিক কাজকর্মে তাঁদের দলীয় কর্মী, বা পঞ্চায়েত কর্মীদের উপর নির্ভর করতে হয়। তাই ঝুঁকিও থেকে যায়। পঞ্চায়েত দফতরের আধিকারিক সুব্রতা চক্রবর্তী জানান, মহিলা প্রধানদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা চলার সময়েই এক পঞ্চায়েত কর্মী একগুচ্ছ ফাঁকা চেক-এ সই করিয়ে নিতে আসেন। ইটভাটার শ্রমিক ওই প্রধান সেদিনই শিখেছেন, ফাঁকা চেক-এ সই করতে নেই, তাই রাজি হননি। “চেকের ছবি দেখিয়ে আমরা মেয়েদের বোঝাই, সইয়ের আগে কী কী দেখে নিতে হবে,” বলেন সুব্রতা।
রাজনৈতিক দলগুলি প্রায়ই মেয়েদের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে অক্ষমতার সুযোগ নেয়। ঝাড়গ্রামের এক আদিবাসী মহিলা প্রধানকে বোঝানো হয়েছিল, দলীয় সদস্য স্ট্যাম্প মেরে দিলে তার উপর সই করাই নিয়ম। সেই মহিলাকে শেষে গয়না বিক্রি করে চুরি-যাওয়া টাকা ফেরত দিতে হয়। দলীয় কর্মীরা তত দিনে দল বদলে ফেলেছেন, জানালেন পঞ্চায়েতেরই এক কর্মী।
স্টেট ইনস্টিটিউট অফ পঞ্চায়েত অ্যান্ড রুরাল ডেভলপমেন্ট-এর এক নমুনা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, এই রাজ্যে সবচেয়ে বেশি অক্ষর-পরিচয়হীন মহিলা পঞ্চায়েত সদস্য বীরভূমে (১৪%), তারপরেই রয়েছে পুরুলিয়া (১১%)। পশ্চিম মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি ও বর্ধমানে মহিলাদের কিছুটা স্কুলশিক্ষা থাকলেও, প্রধান পদে স্কুল-পাশ করা মেয়ের সংখ্যা বেশ কম। পুরুষ পঞ্চায়েত সদস্যদের পড়াশোনা তুলনায় বেশি, আর রাজনৈতিক প্রশিক্ষণও বেশি। সেখানে এখনও অনেক পিছিয়ে মহিলারা। নিজের দফতরের মতো দলেও তাঁরা থেকে যান বাইরের বৃত্তে। তাই ঠকে যাওয়ার ঝুঁকি তাঁদেরই বেশি।
পঞ্চায়েতে মেয়েদের সংরক্ষণের ফল নিয়ে গবেষণা করেছেন আইআইএম কলকাতর অধ্যাপক রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ভারতে সব চেয়ে বড় সমস্য্যা মেয়েদের সাক্ষরতা। সামগ্রিক সাক্ষরতা ৭০-৮০ শতাংশ হলেও আদিবাসী, সংখ্যালঘু, দলিত মহিলাদের মধ্যে ওই হার বেশ কম।”
তার মানে এই নয় যে, স্বল্পশিক্ষিত মেয়েরা পঞ্চায়েতে দায়িত্বপূর্ণ পদে এলে কোনও লাভ হয় না। রাঘববাবু এবং তাঁর সহযোগীদের গবেষণায় বরং ধরা পড়েছে, মহিলা প্রধানরা নারী ও শিশুদের সমস্যার সমাধানে বেশি তৎপর, বেশি টাকা খরচ করেন। কিন্তু পঞ্চায়েতে যখন এত টাকা আসছে, তখন পুরোপুরি কর্মীদের উপর নির্ভরতা কখনওই কাম্য নয়, বলেন রাঘববাবু। তাঁর আক্ষেপ, “সর্বশিক্ষা মিশন শুরু হওয়ার পর বয়স্ক মেয়েদের সাক্ষর করার জন্য সরকারি প্রচেষ্টার প্রায় সম্পূর্ণই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এটা আমাদের একটা অপূরণীয় ক্ষতি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.