আদালতের পাশাপাশি রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকেই কাঠগড়ায় তুলল তৃণমূল। ধর্মতলায় দাঁড়িয়ে শাসক দলের তরফে অভিযোগ করা হল, সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি কমিশনের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পঞ্চায়েত ভোট বানচাল করতে চাইছে। অভিযোগ করা হল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন কর্মসূচি স্তব্ধ করার জন্য কমিশনকে কাজে লাগিয়েছে বিরোধীরা! বলা হল, মহিলা এবং ভোটারদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন মহিলা নির্বাচন কমিশনার! রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক কোনও সংস্থার বিরুদ্ধে রাজপথে এমন রাজনৈতিক সমাবেশ সাম্প্রতিক রাজ্য রাজনীতিতে বেনজির!
তৃণমূলের সমাবেশের অদূরে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে মঙ্গলবারই ঠিক সময়ে পঞ্চায়েত ভোটের দাবিতে অবস্থান ছিল বামফ্রন্টের। ভোট বিলম্বিত করার দায় বিরোধীরা শাসক দলের উপরেই চাপিয়েছে। সেই দায় এড়াতেই পঞ্চায়েত ভোট দ্রুত করার দাবিতে এ দিন থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাল্টা পথে নেমেছে তৃণমূল। মেট্রো চ্যানেলে দলের অবস্থান মঞ্চ থেকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এ দিন ঘোষণা করেছেন, “দ্রুত ভোটের দাবিতে এলাকায় এলাকায় মিছিল করব।” |
কয়েক ঘণ্টার নোটিসে এ দিন ধর্মতলা চত্বরে কর্মসূচি নিয়েছিল দু’পক্ষই। মেট্রো চ্যানেলের এক দিক ট্রাফিক গার্ড রেল দিয়ে আটকে সভা হয়েছে তৃণমূলের। মঞ্চে নেতা ও কর্মীদের যা ভিড় ছিল, সেই তুলনায় নিচে জনসমাগম ছিল অল্প! অবস্থানে কর্মীদের উপস্থিতি দেখে নেতারা প্রকাশ্যে উচ্ছ্বসিত। তবে একান্তে অনেক নেতাই স্বীকার করেছেন, ভিড় আশানুরূপ হয়নি। বেলা দেড়টা থেকে কর্মসূচি শুরু হলেও বিকাল সওয়া চারটের মধ্যে শেষ করে দেওয়া হয়। মুকুলবাবু বলেন, “পুলিশের অনুমতি মেনেই আমরা বিকেল চারটের মধ্যে সভা শেষ করে দিলাম।” কিন্তু আগামী দিনে তাঁরা যে ‘বৃহত্তর আন্দোলন’ করবেন, তা-ও জানান মুকুলবাবু।
পক্ষান্তরে রানি রাসমণিতে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু অভিযোগ করেন, “প্রথম থেকেই আমি বলেছিলাম, চিত্রনাট্যের প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে! ঘটনা পরম্পরায় পরবর্তী পর্ব এখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। পঞ্চায়েত ভোট কিছুতেই লোকসভা নির্বাচনের আগে করা যাবে না, এই উদ্দেশ্য থেকেই নানা ফন্দি-ফিকির করা হচ্ছিল!” রাজ্যে ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় সর্বদল বৈঠকে তৃণমূলের অনুপস্থিতি থেকেই এই ‘ষড়যন্ত্রে’র সূচনা বলে বিমানবাবু এ দিন অভিযোগ করেছেন। তাঁর কথায়, “কবে ভোট হবে, এই প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা হতাম না, যদি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সরকারের সম্মান ও মর্যাদা বোধ থাকত!” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “সংবিধান সংশোধন হওয়ার আগেও এ রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে। আইন, সংবিধান প্রয়োজনে আবার সংশোধন হতেই পারে। কিন্তু আসল কথা হল রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সেই সদিচ্ছা সরকারের নেই। ‘উইল’ (ইচ্ছা) না-থাকলে বিল দিয়ে কিছু হয় না!” ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রবীণ নেতা অশোক ঘোষ মন্তব্য করেন, “রাজ্যের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার যখন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী তখন আইপিএলের অনুষ্ঠানে মগ্ন!”
বিমানবাবুর বক্তৃতার সময় মঞ্চের অদূরেই ট্রাফিক সিগন্যালে আটকেছিল তৃণমূলের সমাবেশ-ফেরত একটি বাস। তার ছাদ থেকে কিছু তৃণমূল সমর্থক বামেদের উদ্দেশে মন্তব্য করছিলেন। যার প্রেক্ষিতে বিমানবাবু বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে নানা প্ররোচনা হবে, অনেক কথা বলা হবে। এই এখনই এক দল অদ্ভুত আচরণ করে গেল! কিন্তু কোনও প্ররোচনায় পা দেওয়া যাবে না।”
তৃণমূলের মঞ্চ থেকে এ দিন শুধু মুকুলবাবুই নন, সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মণীশ গুপ্ত, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, অরূপ রায় থেকে শুরু করে সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, বিধায়ক নুরুজ্জমান প্রমুখ পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে ডামাডোলের দায় কমিশন ও বিরোধী দলগুলির উপরে চাপিয়েছেন। অবস্থান মঞ্চে ভাঙড়ের বিতর্কিত নেতা আরাবুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা রাখার উদ্দেশে মুকুলবাবু এ দিন তাঁদের বলেন, “সদা জাগ্রত থাকতে হবে। আমাদের বিরুদ্ধে অশুভ চক্রান্ত চলছে। আমাদের লড়াই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই।”
বামেদের সভাকে ‘নাটক’ বলে কটাক্ষ করেছে বিজেপি। বক্তব্য, তৃণমূলের মতো সিপিএম-ও চায়নি পঞ্চায়েত ভোট নির্দিষ্ট সময়ে হোক। তাই পঞ্চায়েত জট আদালতে গড়ানোর আগে পর্যন্ত তারা দায়সারা বিবৃতি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “পঞ্চায়েত ভোট হলে সিপিএমের ফল সব চেয়ে খারাপ হবে। অধিকাংশ আসনে তারা প্রার্থীই দিতে পারবে না। এ সত্য বুঝেই তারা ভোট পিছোতে চেয়েছিল। তাই এত দিন নিষ্ক্রিয় ছিল। যে-ই মামলা হয়েছে, অমনি নাটক করছে, যেন ওরা সময়ে ভোট চায়! রোগী মারা যাওয়ার পরে ডাক্তারের কাছে গিয়ে লাভ কী?” |