জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
পঞ্চায়েত ভোট না করে রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত প্রশাসক নিয়োগ করলে গ্রামোন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিল মনমোহন সিংহের সরকার। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের কথায়, “গ্রামোন্নয়ন খাতে কেন্দ্রের বরাদ্দ অর্থ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে খরচ করার কথা। কিন্তু ভোটের মাধ্যমে নতুন পঞ্চায়েতই যদি গঠন না হয়, তা হলে কেন্দ্র সেই অর্থ পাঠাবে কী করে? সুতরাং তখন বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর থাকবে না।”
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পাল্টা জবাব মিলেছে রাজ্য সরকারেরও কাছ থেকেও। রাজ্যের বক্তব্য, গ্রামীণ উন্নয়নের প্রকল্প বিডিও এবং জেলাশাসকের মাধ্যমে রূপায়ণ সম্ভব। বিষয়টি রাজ্যের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। রাজ্যই স্থির করবে কী ভাবে প্রকল্প রূপায়ণ করা হবে।
বস্তুত পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে চলতি অনিশ্চয়তার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছেন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও। পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত এআইসিসি সদস্য শাকিল আহমেদ আজও বলেন, “রাজ্যে জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে তৃণমূলের। তাই লোকসভা ভোটের আগে যে কোনও মূল্যে পঞ্চায়েত ভোট এড়াতে চাইছেন মমতা।” সেই প্রসঙ্গ ধরেই জয়রাম আজ বলেন, “পঞ্চায়েত ভোট না হলে আখেরে ক্ষতি হবে রাজ্যেরই। কারণ, একশো দিনের কাজ, ইন্দিরা আবাস যোজনা বা গ্রামীণ সড়ক প্রকল্পে তখন কেন্দ্রের পক্ষে অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব হবে না।”
পঞ্চায়েত নির্বাচন না হওয়ার ফলে রাজ্য যদি প্রশাসক নিয়োগ করে, তা হলে কি কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক বরাদ্দ কেটে নিতে পারে?
রাজ্যের পঞ্চায়েত দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, পঞ্চায়েতিরাজ মন্ত্রক যে সব প্রকল্পগুলি চালায়, সেগুলির ক্ষেত্রে টাকা পাওয়া যাবে না। কারণ ওই প্রকল্পগুলির শর্তেই বলা থাকে, নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েতকেই স্থানীয় স্তরে প্রকল্পগুলি তৈরি করতে হবে। সেই প্রকল্পের টাকা দেবে কেন্দ্র। প্রশাসকদের প্রকল্প তৈরির ক্ষমতা থাকে না। তাঁরা কেবল রুটিন কাজ দেখাশোনা করতে পারবেন। পঞ্চায়েতিরাজ মন্ত্রকের আওতায় দু’টি প্রকল্প রয়েছে। এক, পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প (বিআরজিএফ), দুই, ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের বরাদ্দ। বিআরজিএফ খাতে বছরে ৪০০ কোটি টাকা এবং অর্থ কমিশন থেকে বছরে ৬০০ কোটি টাকা পায় রাজ্য। এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাঙ্কের অনুদানে রাজ্যের ১০০০ পঞ্চায়েতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রশাসন পরিচালনার তালিম দেওয়া হচ্ছে। এই খাতেও বছরে ২০০ কোটি টাকা আসে। পঞ্চায়েত নির্বাচন না হলে এই তিনটি প্রকল্পে মোট ১২০০ কোটি টাকা কোনও ভাবেই মিলবে না।
পঞ্চায়েত দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, ওই সব প্রকল্প ছাড়াও ১০০ দিনের কাজের টাকা নিয়েও কেন্দ্র টালবাহানা করতে পারে। কারণ এই প্রকল্পের শর্তে বলা হয়েছে, প্রাপ্ত টাকার ৫০ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত গুলিকেই খরচ করতে হবে। প্রকল্পও রচনা করতে হবে গ্রাম পঞ্চায়েতকে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র চাইলে টাকা আটকে দিতেই পারে। চলতি বছরে রাজ্য এই খাতে ৪০০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন করা না গেলে এই টাকা পাওয়াও অনিশ্চিত বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র কি এ ধরনের পদক্ষেপ করতে পারে? জয়রামের সাফ জবাব, তিনি যে পদক্ষেপের কথা বলছেন, তা সংবিধানসম্মত। গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য অর্থ কেন্দ্র থেকে রাজ্যের কাছে যায় ঠিকই, কিন্তু পঞ্চায়েতই স্থির করে, কোথায় কোন প্রকল্প হবে। এবং সেই সব প্রকল্পে পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই অর্থ খরচ করা হয়। প্রকল্প স্থির করা থেকে শুরু করে তার রূপায়ণ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে স্থানীয় মানুষের মতই প্রাধান্য পায়। তাঁদের প্রতিনিধিত্ব থাকে। নতুন পঞ্চায়েত গঠন না হলে সেই কাঠামোটাই আর থাকে না। তিনি আরও বলেন, “অন্ধ্রপ্রদেশে পঞ্চায়েত ভোট না হওয়ায় অতীতে একই ভাবে গ্রামোন্নয়নে কেন্দ্রের বরাদ্দ বন্ধ করা হয়েছিল। কংগ্রেস শাসিত রাজ্য হলেও রেয়াত করা হয়নি।” তিনি জানান, সেই সময় পানীয় জল সরবরাহ দফতরও তাঁর অধীনে ছিল। অন্ধ্রে পঞ্চায়েত ভোট না হওয়ায় সেই খাতে সাড়ে তিনশো কোটি টাকা আটকে রেখেছিলেন তিনি। অন্ধ্র সরকার কেন্দ্রের সঙ্গে বহু চিঠি চালাচালির পর ১০০ দিনের প্রকল্পে টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রতি বছর তারা ১৭০০ কোটি টাকার কেন্দ্রীয় বরাদ্দ পাচ্ছে না বলে জানা গিয়েছে।
কেন্দ্রীয় বরাদ্দ না মেলার আশঙ্কা করছেন রাজ্যের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সচিব মানবেন্দ্রনাথ রায়ও। তাঁর কথায়, “নির্বাচন না হলে যে গ্রাম পঞ্চায়েত থাকবে না, তা নয়। প্রশাসকই পঞ্চায়েত চালাতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে সব প্রকল্পে নিদিষ্ট ভাবে বলা রয়েছে যে পঞ্চায়েত পরিকল্পনা করে টাকা খরচ করবে, সেই সব প্রকল্পে টাকা পাওয়া যাবে না। অন্যান্য প্রকল্পের জন্য রাজ্যের অফিসারদের লড়াই করে টাকা আদায় করতে হবে।” তবে ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রাখা সহজ হবে না বলে মনে করেন মানবেন্দ্রবাবু।
রেল বাজেটের পর থেকেই রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ তুলে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রে বলা হচ্ছে, ৯ এপ্রিল দিল্লিতে এসে ফের এ বিষয়ে সরব হবেন মমতা। বরাদ্দ আটকে দেওয়া নিয়ে জয়রামের মন্তব্যকেও তখন হাতিয়ার করতে পারে তৃণমূল। কেন্দ্রের হুঁশিয়ারি প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আজই বলেন, “কেন্দ্রে সমর্থন প্রত্যাহারের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ ক্রমশই কমানো হচ্ছে। বিশেষ করে সুকৌশলে এটা করছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক।”
জয়রাম অবশ্য এ দিন বঞ্চনা নিয়ে মমতার সরকারের তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি জানান, ক’দিন আগেই একশো দিনের কাজ প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ২৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আগামিকালই প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত দফতরের কর্তাদের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠকের কথা রয়েছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের জন্য আরও ২১৬৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। এ জন্য আনুমানিক খরচ হবে এক হাজার কোটি টাকা। ফলে পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনার কোনও প্রশ্ন নেই। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ গ্রাম সড়ক যোজনায় আরও অর্থ বরাদ্দের জন্য আজই এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের সঙ্গে ২৫.২ কোটি ডলারের একটি চুক্তি সই করেছে রাজ সব মিলিয়ে পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে এত দিন রাজ্য স্তরে কংগ্রেস-তৃণমূলে যে চাপানউতোর চলছিল, তা এ বার জাতীয় স্তরে উঠে আসতে চলেছে। মমতার আসন্ন দিল্লি সফরে তা আরও তীব্র হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। |