আইন অমান্য আন্দোলনে গিয়ে এক ছাত্র নেতার মৃত্যুর ঘটনা ফের অস্ত্র তুলে দিল বামেদের হাতে। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর কথায়, “রক্তের স্বাদ পেয়েছে এই সরকার!” পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন এসএফআইয়ের রাজ্য কমিটির সদস্য সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং দোষী পুলিশদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার দাবি করেছে বামফ্রন্ট। এই ‘হত্যা’র প্রতিবাদে আগামিকাল, বৃহস্পতিবার রাজ্য জুড়ে ধিক্কার দিবসের পাশাপাশি টালিগঞ্জ-গড়িয়া এলাকায় ১২ ঘণ্টার বন্ধের ডাক দিয়েছে তারা।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাতের জেরে পঞ্চায়েত ভোট অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় শাসক দলকে কাঠগড়ায় তুলে পথে নেমেছে বামেরা। তার মধ্যেই সুদীপ্তর মৃত্যু বামেদের তূণে নতুন তির এনে দিয়েছে। পঞ্চায়েত ভোট বানচাল করতে চাওয়ার চেষ্টার প্রতিবাদে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে এ দিন বামফ্রন্টের অবস্থান চলাকালীনই বাম নেতৃত্বের কাছে খবর আসে, আইন অমান্যের পরে পুলিশের মারে সুদীপ্ত এবং এসএফআইয়ের আর এক কর্মী জোসেফ হোসেন গুরুতর আহত। ওখানে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিমানবাবুর নেতৃত্বে সন্ধ্যায় রানি রাসমণি থেকে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার পর্যন্ত প্রতিবাদ মিছিল করেন বাম নেতা-কর্মীরা। |
সুদীপ্তর বাবা প্রণবকুমার গুপ্তকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বিমান বসু।—নিজস্ব চিত্র |
মিছিল শেষে দৃশ্যতই শোক-বিহ্বল বিমানবাবু বলেন, “রক্তের স্বাদ পেয়েছে এই সরকার! এরা নির্বাচন করতে দিচ্ছে না, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে, প্রতিবাদকারীদের উপরে আক্রমণ করছে।” প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষের অভিযোগ, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে, পরিকল্পনা করেই ছাত্র-হত্যা করা হয়েছে!”
মিছিল শেষে হাসপাতাল ঘুরে রাতেই জরুরি বৈঠক বসে আলিমুদ্দিনে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, আজ, বুধবার রাজ্য জুড়ে ধিক্কার মিছিল এবং পরের দিন ধিক্কার দিবস হবে। পরে বিমানবাবু জানান, মৃত সুদীপ্তের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও কাজের এলাকা বলে টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া পর্যন্ত বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। তাঁর আরও বক্তব্য, “ঘটনাস্থলে যারা ছিল, তাদের সকলেরই অভিযোগ ধাক্কা লেগে সুদীপ্ত পড়ে যাওয়ার পরে তাকে পেটানো হয়েছিল। পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীনই গোটা ঘটনা ঘটেছে। ঠিক কী ঘটেছে, জানার জন্যই বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।” এসএফআইয়ের তরফে এ দিন রাতেই হেস্টিংস থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ময়না-তদন্তের পরে গড়িয়ায় সুদীপ্তদের বাড়ি হয়ে মরদেহ আনা হবে এসএফআইয়ের রাজ্য দফতর দীনেশ মজুমদার ভবনে। তার পরে দেহ নিয়ে শোকমিছিল যাবে কেওড়াতলা মহাশ্মশান পর্যন্ত।
এমন ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে সরকার তথা শাসক দল। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের। সম্পূর্ণ ঘটনা না-জেনে কোনও মন্তব্য করা উচিত হবে না।” তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী ঘটনাটিকে দুঃখজনক আখ্যা দিয়েও মন্তব্য করেছেন, “এই ধরনের আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁদের আরও সতর্ক থাকা উচিত।”
তবে অনেক তৃণমূল নেতাই পুলিশের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ নিয়ে দলের অন্দরে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এক নেতার কথায়, “তাদের হেফাজতে থাকাকালীন পুলিশের সতর্ক থাকা উচিত ছিল।” প্রকাশ্যে অবশ্য পুলিশের গাফিলতি নিয়ে তাঁরা মুখ খুলতে নারাজ। কারণ, পুলিশ দফতর রয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। যাঁর ভাইপো এবং তৃণমূল ‘যুবা’র নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “দুর্ঘটনাজনিত সব মৃত্যুই দুঃখের। বিশেষত, তরুণ কারও জীবনের মূল্য সমাজের কাছে অপরিসীম। এই ঘটনা রাজনীতির ঊর্ধ্বে।”
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা অবশ্য ‘যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক’ বললেও এসএফআই এবং সিপিএম নেতৃত্বকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে দোষারোপ করতে ছাড়েননি! তাঁর কথায়, “এই ধরনের আন্দোলনে যে কোনও সময় যে কোনও কিছু ঘটতে পারে জেনেও নেতারা ছাত্রছাত্রীদের সামনে এগিয়ে দিয়েছেন। এটা বিপজ্জনক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র!” বিমানবাবু আবার পাল্টা বলেছেন, “ছাত্র আন্দোলনে তাদের আচরণ কেমন হয়, সবাই জানে। সেই ভাবেই বছরের পর বছর ধরে ছাত্র আন্দোলন হয়ে আসছে!”
আহত হওয়ার পরেও সুদীপ্তকে পুলিশি মারধরের অভিযোগ এনেই এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশের হেফাজতে সুদীপ্তর মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর জখম হয়েছেন এসএফআইয়ের আরও তিন কর্মী। এই ঘটনা গণতন্ত্রের পক্ষে লজ্জাজনক।”
ঘটনার জেরে প্রতিবাদ করতে পিছপা হয়নি অন্য বিরোধীরাও। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের দাবি, “পুলিশই এখানে মূল অপরাধী। তৃতীয় কোনও পক্ষকে দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। পুলিশের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা উচিত সরকারের।” ঘটনার প্রতিবাদে আজ ‘কালা দিবস’ পালন করবে ছাত্র পরিষদ। সিপিআই (এমএল) লিবারেশন, এসইউসি-ও ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দাবি করেছে। |