দিনভর বাতাসে ভাসে মুরগির পালক। রাস্তায় যথেচ্ছ ছড়িয়ে থাকে মরা মুরগির পালক, নাড়িভুঁড়ি। তা নিয়ে চলে কুকুরের খেয়োখেয়ি। রাত নামলে দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের একাংশ সারাদিন মুরগির মাংস বিক্রি করার সময়ে যে আবর্জনা জমেছে তা রাস্তার মাঝখানে ফেলে চলে গিয়েছেন। সেখানে শতাধিক কুকুরের ভিড়, কামড়াকামড়ি চলে রাতভর।
সংক্ষেপে এটাই হল শিলিগুড়ির প্রাচীন বিধান মার্কেটের মাছবাজার লাগোয়া মুরগিহাটার রোজকার ছবি। পুরসভার মেয়র, কমিশনার, এসডিও, পুলিশ কর্তা, দল মত নির্বিশেষে সব দলের কাউন্সিলররা বছরের পর বছর এই দৃশ্য দেখছেন। কিন্তু, হাল ফেরাতে যে কড়াকড়ি করা দরকার তা করতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্তারা। অথচ সকলেই চান, মুরগিহাটের হাল ফিরুক। তা হলে ফিরছে না কেন সেই প্রশ্নের উত্তরে চলছে নানা চাপানউতোর।
পুরসভা সূত্রের খবর, দৈনিক গড়ে অন্তত ১০ হাজার মানুষ বিধান মার্কেট লাগোয়া ওই মাছ বাজার ও মুরগি হাটে যাতায়াত করেন। দার্জিলিং তো বটেই, সিকিম, নেপাল, ভুটান থেকেও অনেকে ওই বাজারে কেনাকাটা করেন। সেখানে দৃশ্য দূষণ এড়াতে মুরগি কাটার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করার দাবি উঠেছে। বিধান মার্কেটের ব্যবসায়ীদের অনেকে জানান, মুরগির পালক, নাড়িভুঁড়ি যাতে রাস্তায় না ফেলা হয় সে জন্য পুরসভা কড়াকড়ি করলে তাঁদের আপত্তি নেই। ওই এলাকার কাউন্সিলর হলেন নান্টু পাল। বাম আমলে তিনি সিপিএম কাউন্সিলর হিসেবে জিতে বরো চেয়ারম্যান ছিলেন। কংগ্রেসে যোগ দিয়ে কাউন্সিলর হয়ে ডেপুটি মেয়র হন। পরে তৃণমূলে যোগ দিয়ে ফের চেয়ারম্যান হয়েছেন। এখনও চেয়ারম্যান পদ ও দলত্যাগ নিয়ে বিতর্ক তাড়া করছে তাঁকে। মুরগিহাটের দূষণ রোধের ব্যবস্থা করতে নান্টুবাবু ব্যর্থ কেন সেই প্রশ্নে কোনও সদুত্তর মেলেনি। নান্টুবাবু বলেন, “মুরগিহাটের রাস্তাটা ফের পাকা করা হচ্ছে। এপ্রিল মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।” |
বিধান মাকের্ট সংলগ্ন এলাকায় তোলা নিজস্ব চিত্র। |
এলাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের অনেকের অভিযোগ, নান্টুবাবু তৎপর নন বলেই মুরগিহাটের সমস্যা মিটছে না। এমনকী, বাম আমলে তৎকালীন মেয়র নুরুল ইসলাম পরে কংগ্রেসের মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত একাধিক বার মুরগি হাটের হাল ফেরাতে উদ্যোগী হলেও কাউন্সিলরের তরফে সাড়া মেলেনি বলে পুর মহলেই অভিযোগ রয়েছে। মুরগিহাটের একাধিক ব্যবসায়ী রসিকতার সুরে জানান, তাঁদের কাউন্সিলর ঘন ঘন দল পাল্টাতে এত ব্যস্ত যে মুরগিহাটের চেহারা পাল্টানোর সময় পাচ্ছেন না!
ওই এলাকায় নিয়মিত যাঁরা যান তাঁরা কী বলছেন দেখা যাক। হাকিমপাড়ার সঞ্জয় দাস জানান, বাচ্চাদের ওই বাজারে গেলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনা। পূর্ত দফতরের এক বাস্তুকার গোবিন্দ আচার্য বলেন, “মুখে রুমাল চাপা দিয়ে বাজার করতে হয়।” অরুণিমা চট্টোপাধ্যায়ের মতো অনেক গৃহবধূ এখন মুরগিহাটের দূষণ দেখে সেখানে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। অরুণিমা দেবী বলেন, “ওই জায়গার যা হাল সেখানে গেলেই মাথা ঝিমঝিম করে। তাই ওই রাস্তাটা এড়িয়ে চলি। আমার স্বামীই বাজারে যান।” শিলিগুড়ি কলেজের ছাত্রী বিদিশা মিত্র জানান, নেতা-কর্তারা যেখানে নিয়মিত বাজার করতে যান, সেই এলাকাকে ঝকঝকে দূষণ মুক্ত করতে পারেন না কেন সেই রহস্য ভেদ হওয়া দরকার। নিয়মিত বাজারে যান শিলিগুড়ির শল্য চিকিৎসক শৈলজা গুপ্ত। তিনি বলেন,“আমরা তো সামান্য সময়ের জন্য বাজারে থাকি। যাঁরা বসে ব্যবসা করেন তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ। ফুসফুসের নানা রোগ হতে পারে।”
মুরগি হাটের ব্যবসায়ীরাও উদ্বিগ্ন। ব্যবসায়ী রবি রায় বলেন, “আমি ২৫ বছর এখানে ব্যবসা করছি। জায়গার অভাবে রাস্তার উপরে মালপত্র রাখতে হয়। তাই ইচ্ছে না থাকলেও রাস্তায় আবর্জনা জমা করতে হয়”। তাতে যে পরিবেশ দূষণের পাশপাশি নিজেদের রোগ ভোগ হচ্ছে তা জানলেও অশোক মণ্ডলের বক্তব্য,“কি করা যাবে? পুরসভার কাছে দোকান উঁচু করার প্রস্তাব দিলেও তারা উদ্যোগী হচ্ছেন না। ফলে বাধ্য হয়েই কার্যত নরকের মধ্যে বসে বিপদ মাথায় নিয়ে আমাদের ব্যবসা করতে হচ্ছে।”
|
উবাচ |
• এসজেডিএ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে বহুতল বাজার করে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন দেওয়ার। কিন্তু কে কোন জায়গা নেবেন সেই প্রশ্নেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে গোল মেটেনি।
গোপাল লামা, অতিরিক্ত জেলাশাসক, দার্জিলিং
|
• বিধান মার্কেটের মাছ বাজার ও মুরগি হাট নরক কুণ্ড। রাস্তাও দখল হয়ে গিয়েছে। মোটরবাইক নিয়েও বাজারে ঢোকা যায় না। অবিলম্বে এর প্রতিকার করা প্রয়োজন।
মলয় চক্রবর্তী, আইনজীবী, শিলিগুড়ি
|
• গৌতম দেব, মেয়র পারিষদ দুলাল দত্তকে জানিয়েছিলাম। দ্রুত কাজ হওয়া প্রয়োজন। এলাকা ক্রমশ দূষিত হচ্ছে।
অরূপরতন ঘোষ, সচিব, শিলিগুড়ি মহকুমা ক্রীড়া পরিষদ
|
• বিধান মার্কেটের লাগোয়া মাছবাজার ও মুরগিহাটের দূষণ মাত্রাছাড়া ও অসহ্য হয়ে উঠছে। নাগরিকদের সরব হতে হবে।
শুভাশিস ভৌমিক, বাস্তুকার |
|