|
|
|
|
‘টাডা’-র ফাঁদে সঞ্জয় ও অর্জুন |
জঙ্গি তকমা নিয়েই মৃত্যু বৃদ্ধের, সঞ্জয়ের পাশে দেশ |
রাজীবাক্ষ রক্ষিত • গুয়াহাটি |
তাঁদের দু’জনের মধ্যে মিল একটাই— ‘টাডা’। কিন্তু গরমিল আছে অনেক।
এক জন সঞ্জয় দত্ত। বলিউডের নায়ক। কিন্তু বাস্তবে কখনও কখনও খলনায়কও হয়ে উঠেছেন তিনি। বন্ধু স্থানীয় মাফিয়া ডনের কাছ থেকে বেআইনি স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নেওয়া ও সেই অস্ত্র লুকিয়ে রাখার অপরাধে টাডা আইনে ধরা পড়ে ১৮ মাস জেল খাটেন। কিন্তু সেই সঞ্জয়কেই আইন যখন আরও সাড়ে তিন বছর কারাবাসের সাজা শোনালো, ভেঙে পড়ল গোটা দেশ। সকলেরই বক্তব্য, নেহাতই ‘ছেলেমানুষি’ করে ফেলেছেন সঞ্জয়।
তাই বলে আবার শাস্তি?
অন্য জন অর্জুন শর্মা। বর্তমানে প্রয়াত। না, কোনও খ্যাতনামা কেউ নন। নেহাতই অসমের এক প্রত্যন্ত গ্রামের গোয়ালা। তখন সত্তর বছরের বৃদ্ধ। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জোগাড়ে আর গরুদের দেখাশোনা করতেই নাজেহাল। সেই বৃদ্ধ হঠাৎই এক দিন গ্রেফতার হলেন। গ্রেফতারের পরে জানতে পারলেন, তাঁর জমি খুঁড়ে উদ্ধার হয়েছে আলফা জঙ্গিদের লুকিয়ে রাখা শতাধিক বন্দুক-রাইফেল। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দফায়-দফায় জেল খেটে চললেন। সত্তরে টাডা-য় ধৃত ‘টেররিস্ট’ বৃদ্ধ ৯০ বছরে যখন মারা গেলেন তখনও আদালত তাঁকে ‘নির্দোষ’ ঘোষণা করেনি। টাডা অপরাধী হিসেবেই তাঁকে মরতে হয়েছে। তা-ও সম্পূর্ণ একলা।
দেশজুড়ে সঞ্জয়ের সাজা মকুব নিয়ে হইচইয়ের মধ্যেই আলফার প্রতিষ্ঠা দিবসও আসছে। দু’য়ের মাঝখানে অর্জুনবাবুর পরিবারের আফশোস, নিরাপরাধ অর্জুনের পাশে ছিল না দেশের সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক নেতারা। ছিলেন না আলফার আলোচনাপন্থী সভাপতিও।
১৯৯১ সালে অসমের নগাঁও জেলার চাঁপানালার বাড়ি থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধ অর্জুনবাবুকে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে। তাঁর জমি খুঁড়ে মিলেছিল ১০০টি একনলা ও দোনলা বন্দুক। হতবাক বৃদ্ধের কোনও আপত্তি শোনা হয়নি। মারধরের পরে তাঁকে ‘টাডা’ আইনে বেঁধে ফেলা হয়। তাঁর আইনজীবী শান্তনু ভরালির কথায়, বৃদ্ধের বিরুদ্ধে পুলিশ মোট ৮৬টি মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৯৫ সালে প্রথম বার জামিন পান তিনি, বয়স ৭৪। বাড়ি ফিরে দেখেন সব গরু চুরি হয়ে গিয়েছে। তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। নিঃসঙ্গ, নিঃস্ব বৃদ্ধ দু’বছর আদালতে যাতায়াত করেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেননি। বরং ১৯৯৭ সালে ফের গ্রেফতার হন। এরপর ২০টি মামলায় জামিন পাওয়া ৭৬ বছরের বৃদ্ধকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় এই শর্তে: যে বাকি মামলাগুলির জন্য নিয়ম করে প্রতি মাসে তাঁকে হাইকোর্টে হাজিরা দিতে হবে। কিন্তু এক একটি মামলা এক এক দিন দায়ের হওয়ায় নগাঁও থেকে প্রায় প্রতি দিনই তাঁর পক্ষে গুয়াহাটি আসা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন অর্জুনবাবু। তার পর সেখান থেকেই পুলিশ ফের তাঁকে গ্রেফতার করে আনে। তিনি ফের কারাবন্দি হন। পরে আবার জামিন হয়। সেই অবস্থায়, দু’বছর আগে, ২০১১ সালে অর্জুন শর্মা মারা যান। কিন্তু দুই দশকের লড়াই ও কারাবাসের পরেও ৯০ বছরের বৃদ্ধ প্রমাণ করে যেতে পারেননি, তিনি নির্দোষ।
আলফা সভাপতি অরবিন্দ রাজখোয়া আত্মসমর্পণ করে শান্তি আলোচনা শুরু করেছেন। রাজ্যের বিভিন্ন অংশে সন্ত্রাসের বলি হওয়া পরিবারের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি।
কিন্তু অর্জুনবাবুর কথা হয়তো কারও মনে নেই। আগামী ৭ এপ্রিল আলফার প্রতিষ্ঠা দিবস। সে দিন ‘ফোরাম অফ টেররিস্ট ভিকটিম্স ফ্যামিলি অফ অসম’ রাস্তায় নেমে আলফা নেতাদের কৃতকর্মের বিচার ও স্বজনদের উপরে হওয়া অকারণ অত্যাচারের জবাব চাইবে। জবাব চাইবে বৃদ্ধ অর্জুন শর্মার হয়েও। |
|
|
|
|
|