প্রবন্ধ ২...
আগেও খুব কিছু হয়নি, এখনও হচ্ছে না
মিত মিত্র রাজ্য বিধানসভায় যে বাজেটটি পেশ করলেন, তাতে প্রত্যাশিত অনেক কিছুই আছে। অপ্রত্যাশিতও। প্রত্যাশিতের তালিকায় এক নম্বরে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পর স্বামী বিবেকানন্দ এবং নজরুল ইসলাম। মা-মাটি-মানুষ এবং তাদের দিদিও প্রত্যাশিত ভাবেই উপস্থিত।
অপ্রত্যাশিতের তালিকায় আছেন মির্জা গালিব। এবং, বেশ কিছু অযৌক্তিক অহঙ্কার। সরকারের সাফল্যের ফিরিস্তি দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী খুবই গোলমাল করে ফেলেছেন। বাজেটের একেবারে গোড়ায় তিনি জানিয়ে দিলেন, ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির গড় হার ৭.৬ শতাংশ, এবং ভারতের আয় বৃদ্ধির গড় হার মাত্র ৪.৯৬ শতাংশ। এই তথ্যে যে আসলে গর্বিত হওয়ার বিশেষ কারণ নেই, মুখ্যমন্ত্রী না বুঝুন, অর্থশাস্ত্রে প্রশিক্ষিত অমিত মিত্র বিলক্ষণ বুঝবেন। বাম আমলের আর্থিক বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের আমলের হারের কার্যত ফারাক নেই। ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে এই রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৮ শতাংশের সামান্য বেশি, তার পরের বছর ৯.২২ শতাংশ। যোজনা কমিশনের পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যাচ্ছে, একাদশ যোজনা চলার সময়, অর্থাৎ ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি বছরে গড়ে ৭.৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই, এই বছরের বৃদ্ধির হার আলাদা করে গর্ব করার মতো কোনও কৃতিত্ব নয়। বৃদ্ধির হারের কথাই যদি তুলতে হয়, তবে প্রতিবেশী বিহারের কথা উল্লেখ না করলে অপরাধ হবে। ২০১১-১২ অর্থবর্ষে বিহারে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ১৩.১ শতাংশ। ২০১২-১৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১১.৯৫ শতাংশে।
উৎসবে, ব্যসনে। মাটি উৎসবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আয়বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে অমিত মিত্র খুব বেশি কিছু করে উঠতে পারেননি, তার আরও একটি প্রমাণ মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির সূচক। ২০০৪-০৫ সালকে ভিত্তির বছর ধরলে বাম আমলের শেষ পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে যে হারে মাথাপিছু আয় বেড়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারও কম-বেশি সেই হারেই আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। উগ্র সিপিএম সমর্থক হলে বলবেন, বরং বাম আমলেই ভাল হয়েছিল ২০১০-১১ সালে মাথাপিছু আয় বেড়েছিল ৮.৩৯ শতাশ হারে; তার পরের দু’বছরে এই হার যথাক্রমে ৫.৭৮ এবং ৬.৮৫ শতাংশ। তবে, আয়বৃদ্ধি নিয়ে অমিত মিত্র মশাইকে যে কথা বলার, সেই উগ্র সিপিএম সমর্থককেও তাই বলা প্রয়োজন এক বছরের হিসেব নিয়ে বেশি উত্তেজিত না হওয়াই ভাল। সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির অবস্থার বিশেষ উন্নতি করতে পারেনি। তৃণমূল কংগ্রেসও পারছে না।
বামফ্রন্টের ফেলে যাওয়া ঋণের বোঝা অমিত মিত্রের, এবং তাঁর নেত্রীর, বিশেষ মর্মবেদনার কারণ। আরও এক বার বিহারের উদাহরণ টেনে আনা যাক। সে রাজ্যে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সরকার যখন নির্বাচনে হারল, নীতীশ কুমার ক্ষমতায় এলেন, তখন তার ঋণের পরিমাণ ছিল রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৫৩ শতাংশ। বামফ্রন্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাড়ে যে বোঝা চাপিয়েছে, তা পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৪৩ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ, নীতীশ কুমারের সমস্যা বেশি বই কম ছিল না। বিহারের ঋণের পরিমাণ এখন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ২৪ শতাংশ।
গত বছরের বাজেটে অমিত মিত্র একটি নতুন স্লোগান বাজারে ছেড়েছিলেন: ‘কৃষক আমাদের গৌরব, কৃষি আমাদের সম্পদ’। কাজেই, রাজ্য কৃষিতে কতখানি উন্নতি করল, অর্থমন্ত্রী এই বাজেটে সেটা জানাবেন বলে আশা ছিল। অমিত মিত্র শুধু উল্লেখ করেছেন, কৃষিতে বৃদ্ধির হার ২.৫৬ শতাংশ। উল্লেখ করেননি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়, সাম্প্রতিক অতীতে, কৃষিতে বৃদ্ধির হার অন্তত দু’বার বর্তমান হারের তিন গুণ হয়েছিল। এবং, গত বছরই এই রাজ্যে কৃষিতে বৃদ্ধির হার ছিল ১.৬২ শতাংশ। রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে কৃষির অংশীদারি ক্রমেই কমেছে। অর্থনীতির উন্নতি হলে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দু’টো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এক, অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে কৃষির অবদান যে হারে কমেছে, কৃষিতে নিযুক্ত লোকসংখ্যাও কি সেই অনুপাতেই হ্রাস পেয়েছে? তা না হলে বুঝতে হবে, যে কৃষক এই সরকারের গৌরব, তার আর্থিক অবস্থা প্রতি বছর খারাপ হচ্ছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, মোট উৎপাদনে কৃষির অবদান কমলে তা পূরণ হচ্ছে কোন ক্ষেত্র থেকে?
শিল্পের দিকে এ বার তাকাতেই হচ্ছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন বিষয়ে সক্রিয় হওয়ার পর এই রাজ্যে প্রকল্পের সংখ্যা যে হারে বাড়ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তা কমে গিয়ে কার্যত ২০০০-০১ সালের স্তরে ফিরে গিয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে মোট লগ্নি এসেছে ৩১২.২৪ কোটি টাকা। ২০১০ সালে তা ছিল ১৫০৫২.২৩ কোটি টাকা। অবনতি, নিঃসন্দেহে। তবে এখানে বলা প্রয়োজন, ভারতের শিল্পোন্নত রাজ্যগুলির সঙ্গে তুলনা করলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও কোনও কৃতিত্ব দেওয়া অসম্ভব। কোনও আমলেই আসলে পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট, এবং গুরুত্বপূর্ণ, বিনিয়োগ আসেনি। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পোৎপাদনের সূচকও বলছে, কোনও আমলেই বিশেষ সুবিধে হয়নি, তৃণমূলের আমলে তো নয়ই।
অমিত মিত্রর বাজেট বক্তৃতায় স্বাভাবিক ভাবেই এই সব প্রসঙ্গ আসেনি। তিনি প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ শুনিয়ে দায় সেরেছেন। তাঁর এই আচরণকে কেউ অসততা বললে প্রতিবাদ করা মুশকিল হবে। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পক্ষেত্রের দুটি বড় সমস্যার কথা তাঁরই বাজেটের পরিসংখ্যান থেকে বেরিয়ে আসছে। এক, এই রাজ্যে প্রকল্পপিছু বিনিয়োগের পরিমাণ চিরকালই কম। অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে বড় শিল্প এই রাজ্যে আসছে না। দুই, তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পপিছু কর্মসংস্থান বেশ রকম বেড়েছে। কর্মসংস্থান বাড়া ভাল কথা, কিন্তু তা যদি বিনিয়োগের পরিমাণের সঙ্গে সঙ্গতিহীন হয়, তবে মুশকিল। আশঙ্কা থেকে যায়, এই কর্মসংস্থানের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ উৎপাদনশীলতাহীন।
পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের আর একটা বড় সমস্যা হল, সংগঠিত ক্ষেত্রের তুলনায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের দাপট বেশি। কথাটা পরিবর্তনের আগেও সত্য ছিল, পরিবর্তনের পরেও সত্য। অতি ক্ষুদ্র শিল্পকে দু’ভাগে ভাগ করে দেখা ভাল কোনও বড় শিল্পের অনুসারী অতি ক্ষুদ্র শিল্প; আর বেকারত্বের হাত থেকে বাঁচার জন্য অতি ক্ষুদ্র শিল্প। প্রথম ধরনের অতি ক্ষুদ্র শিল্প অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, দ্বিতীয়টি বিপজ্জনক কারণ দ্বিতীয় ধরনের অতি ক্ষুদ্র শিল্প বাড়তে পারে না, খুব ছোট মাপেই আটকে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের অসংগঠিত ক্ষেত্র সম্পর্কেও এই কথাটি বলা চলে। এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কী উৎপাদন হয় মুখ্যমন্ত্রীর কথা মেনে বিড়ি আর চানাচুর, না কি অন্য কিছু এই মুহূর্তে সেই পরিসংখ্যান হাতের কাছে নেই। কাজেই সাবধান থাকা ভাল।
অমিত মিত্রের হিসেব বলছে, গত এক বছরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজস্ব কর-রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়িয়েছে ৩০ শতাংশ। কথাটি সত্য হলে গর্বিত না হওয়ার কোনও কারণ নেই। প্রশ্ন হল, কথাটি কি সত্য?
অর্থমন্ত্রী যে হিসেব দেখিয়েছেন, সেটা টাকার অঙ্কের আপাত হিসেব। এর থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিতে হবে। তার পর যা পাওয়া যাবে, সেটাই প্রকৃত হিসেব। অর্থনীতির যে কোনও পরিসংখ্যান এই প্রকৃত হিসেবে হওয়াই দস্তুর। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭.৬ শতাংশ। সেটা বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের কর রাজস্ব আদায়ের বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ২২.৩ শতাংশে।
এই হারে ধরণীতল উতলা না হলেও হারটি মন্দ নয়। কিন্তু এই ২২.৩ শতাংশ বৃদ্ধির হারের পুরো কৃতিত্বও অমিত মিত্র মশাইকে দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি ক্ষমতায় আসার পর পণ্য প্রবেশ কর নামক একটি কর বসিয়েছিলেন ভিন্ রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে সব পণ্য আসে, তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য বাদ দিলে আর সব কিছুর ওপর তিনি কর আরোপ করেছিলেন। এ বছর তার থেকে আয় হয়েছে ১২৩৫.৫ কোটি টাকা। খেয়াল রাখা ভাল, এই কর কিন্তু সরাসরি জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়। মা-মাটি-মানুষের সরকার আমজনতার সংসার খরচ বাড়িয়ে এই বাড়তি ১২৩৫.৫ কোটি টাকা আদায় করেছে এই কথাটা অর্থমন্ত্রী তাঁর ভাষণে স্পষ্ট করে বললে কী হত, কল্পনা করেও শিউরে উঠছি!
‘কৃতিত্বের’ আর এক ভাগীদার মনমোহন সিংহ। তিনি ডিজেল-পেট্রোলের দাম বাড়ালেন বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইউপিএ ছেড়ে দিলেন বটে, কিন্তু পেট্রোলিয়ামের ওপর আদায় করা রাজ্যের বিক্রয় কর তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল। প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ পেট্রোলিয়ামের ওপর বেশ চড়া হারে বিক্রয় কর আদায় করে। গত এক বছরে ডিজেলের দাম বেড়েছে লিটারে সাড়ে আট টাকার কাছাকাছি, পেট্রোল লিটারে সাড়ে ছ’টাকা। তাতে রাজ্যের রাজকোষে বাড়তি এসেছে ১২০ কোটি টাকা।
পণ্য প্রবেশ কর ও পেট্রোলিয়ামের বাড়তি বিক্রয় কর বাদ দিলে, টাকার অঙ্কেই কর বৃদ্ধির হার ২৪.৫ শতাংশ। বামফ্রন্ট সাম্প্রতিক অতীতে খুব বেশি বার এই হারে পৌঁছতে পারেনি, ঠিকই। কিন্তু, মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিলে অমিত মিত্রই বা কোথায় দাঁড়ালেন? তাঁর রাজস্ব বৃদ্ধির প্রকৃত হার ১৬.৯ শতাংশ। খুব শ্লাঘার কারণ কি?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.