প্রবন্ধ ১...
আফ্রিকায় উপনিবেশ চলছে, চলবে
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক-এ ফরাসি সৈন্যদের গুলিতে দুই ভারতীয়ের মৃত্যু এবং ছয় ভারতীয়ের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া অলাঁদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে চিঠি লিখেছেন। মধ্য আফ্রিকার লাখ পঞ্চাশেক মানুষের এই দেশটিতে এখন ফ্রান্সের অনুগত বনাম বিরোধীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে। অনুগামীদের ‘অনুরোধে’ ফ্রান্স সে দেশে ৩০০ সৈন্য পাঠিয়েছে, যারা বিমানবন্দর সহ রাজধানী বাঙ্গুই-এর সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দখল নিয়েছে। ভারতীয়রা বিমানবন্দরে ঢুকছিলেন, তাঁদের ‘ভুল করে’ লুঠেরা বা বিদ্রোহী ভেবে ফরাসি সৈন্যরা হত্যা করে। কিছু কাল আগে কেরল উপকূলে এ ভাবেই ভারতীয় ধীবরদের ‘জলদস্যু’ ভেবে ইতালীয় নৌসেনারা হত্যা করেছিল।
দখল। ফ্রঁসোয়া বজিজ-এর পোস্টারের সামনে ফরাসি সেনা। বাঙ্গুই, ২৪ মার্চ। ছবি: রয়টার্স
এ ধরনের ভুলের জন্য কোনও মাসুল গুনতে হয় না। দুঃখপ্রকাশের বিবৃতিও লাগে না অনেক সময়। আফ্রিকায় পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদীদের অন্তত লাগে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর উপনিবেশবাদ তাই একুশ শতকেও আফ্রিকা মহাদেশে অনায়াসে পুনরুদ্ভাবিত হয় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের চেহারায়। লিবিয়ায় ইউরোপীয় শক্তিধরদের তুমুল বোমাবর্ষণের নেপথ্যে গদ্দাফি বিতাড়নের যে-যুক্তি ছিল কিংবা সিরিয়ায় যে-যুক্তিতে আসাদ-বিরোধীদের মদত দেওয়া হচ্ছে, তা একান্ত ভাবেই সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকামিতার সনাতন অজুহাত। একদা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স এর পর মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে একই যুক্তিতে সেনা পাঠাচ্ছে। মুখে ইসলামপন্থীদের ঠেকিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির হাত শক্ত করার কথা আওড়ালেও আসলে ফরাসি লগ্নি পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই সামরিক অভিযান। মালির অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি ইউরেনিয়ামের পুরোটাই ফ্রান্সে যায়, যা দিয়ে সে-দেশের পরমাণু বিদ্যুতের জ্বালানির চাহিদা মেটে (এবং ফ্রান্সের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের তিন-চতুর্থাংশই পরমাণু বিদ্যুৎ)। তাই মালির তিন হাজার জেহাদি সন্ত্রাসবাদীকে (মরুচর তুয়ারেগ যাযাবর) নিশ্চিহ্ন করতে যে চার হাজার ফরাসি সৈন্য সেখানে মোতায়েন হয়েছে, সহসা তারা স্বদেশে ফিরবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে জেহাদিমুক্ত করার নামে মালির একের পর এক জনপদ-- গাও, টিম্বাকটু, কিদাল ফরাসি বিমানহানা ও সাঁজোয়া-কামান বর্ষণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত, শত-শত শিশুনারীবৃদ্ধ নিহত, পঙ্গু।
এরই মধ্যে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ‘গৃহযুদ্ধ’। প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া বজিজ দেশ ছেড়ে পলাতক। রাজধানী বাঙ্গুইয়ের দিকে অগ্রসরমাণ বিদ্রোহীরা। অনুগত রাজনীতিককে গদিতে বসাতে তিনশো ফরাসি সৈন্য বিমানবন্দরে নেমেছে। উপনিবেশবাদ আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায় নেওয়ার পর থেকে চল্লিশ বছরে এ ভাবে পঞ্চাশ বারেরও বেশি প্রত্যক্ষ ফরাসি সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে আফ্রিকায়। ষাটের দশকে স্বাধীনতা দেওয়ার ঠিক আগে ফ্রান্স তার আফ্রিকান উপনিবেশগুলিকে ‘বাধ্যতামূলক সংহতি’র বলয়ে টেনে আনতে এক অভিনব চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী ১৪টি সাবেক উপনিবেশ তাদের বিদেশি মুদ্রাভাণ্ডারের ৬৫ শতাংশ ফ্রান্সের কোষাগারে গচ্ছিত রাখতে বাধ্য, আরও ২০ শতাংশ বিভিন্ন আর্থিক দায় মেটাতে। বাকিটুকু তারা নিজেরা ব্যবহার করতে পারে। এর বেশি অর্থের প্রয়োজন হলে বাজারের সুদের হারে ধার নিতে হয় নিজেদেরই গচ্ছিত তহবিল থেকে। সেই তহবিল কিন্তু প্যারিসের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে ফ্রান্সই লভ্যাংশ পায়। সাম্য, স্বাধীনতা, সৌভ্রাত্র্যের চমকপ্রদ নিদর্শন।
এই ১৪টি দেশে প্রাপ্ত বা আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক বা খনিজ সম্পদ কেনার বা না কেনার প্রাথমিক অধিকারও ফ্রান্সের। অন্য দেশ বেশি দাম দিলেও তাদের বেচা যাবে না। সরকারি কাজের ঠিকা দিতে হবে ফরাসি সংস্থাগুলিকেই। আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট লর্যাঁ গাবাগো একটি সেতু গড়তে চাইলে ফরাসি সংস্থা বিপুল দর হাঁকে, যা ইউরো বা মার্কিন ডলারে মেটাতে হবে। একটি চিনা সংস্থা অর্ধেক দামে (যা আবার শোধ করতে হবে মুদ্রায় নয়, কোকো-বিন দিয়ে, এই দেশই বিশ্বে যার বৃহত্তম উৎপাদক) সেতুটি বানিয়ে দিতে রাজি থাকলেও ফ্রান্সের আপত্তিতে তা ভেস্তে যায়। এই ১৪টি দেশের জল বিদ্যুৎ টেলিফোন পরিবহণ বন্দর ব্যাংক বাণিজ্য কৃষি নির্মাণ-শিল্প, সবই ফরাসি কর্পোরেট সংস্থার নিয়ন্ত্রণে। ইউরেনিয়ামের কথা আগেই বলেছি। মালি একই সঙ্গে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সোনা উৎপাদকও বটে, তেল ও অন্য খনিজ সম্পদের ভাণ্ডারও পর্যাপ্ত। কিন্তু আফ্রিকার অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে চলেছে। নিজেদের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে রাজি নয় জাতীয়তাবাদীরা। বুরকিনা ফাসোর বিপ্লবী নেতা টমাস সাংকারা যথার্থ স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের দাবি আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছিলেন, পশ্চিমের অনুগ্রহে পুষ্ট ব্লেজ কাম্পোরে তাঁকে হত্যা করে এখনও ক্ষমতাসীন। পশ্চিম দুনিয়া কাম্পোরোকে সম্মানিতও করেছে। জাতীয়তাবাদীদের দমন করতে উপনিবেশবাদীরা প্রায়শ জেহাদি ইসলামকে কোণঠাসা করার অপযুক্তি শানায়। অথচ মজার ব্যাপার, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ায় এই জেহাদিদেরই তারা অস্ত্রসজ্জিত করে জাতীয়তাবাদী শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করতে সচেষ্ট থেকেছে।
১৮৯০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ী ও রাজপুরুষ সেসিল রোড্স কেপ টাউন থেকে কায়রো পর্যন্ত রেলপথ বানিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থে মহাদেশের উত্তর-দক্ষিণকে খাড়াখাড়ি শামিল করতে চেয়েছিলেন। ফরাসি উপনিবেশবাদীরা তার পাল্টা পশ্চিম থেকে পুবে আড়াআড়ি হাইওয়ে বানাবার পক্ষপাতী ছিলেন, যাতে সহজে এবং দ্রুত পশ্চিম এশিয়ায় পৌঁছনো যায়। মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে সামরিক আগ্রাসন কি সেই ফরাসি রণনীতিরই পুনরুজ্জীবন? রোড্স মনে করতেন, ‘মানব প্রজাতির সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট নমুনাগুলি যে সব স্থানে বসবাস করে, সেগুলি যদি অ্যাংলো-স্যাক্সন নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে এক বার ভাবুন, কী অমিত সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে, কত অসংখ্য নতুন কর্মসংস্থান হতে পারবে!’ পশ্চিমী অর্থনীতির বর্তমান মন্দা ও দুর্দশা আপাতত বহাল থাকছে। আফ্রিকার দখল পাওয়ার পাশ্চাত্য প্রতিযোগিতায় ফ্রান্সের এগিয়ে থাকার প্রয়াস কি সেই সঙ্কট থেকে ত্রাণেরও মরিয়া উদ্যম?
পশ্চিমী আধিপত্যকামীদের সমান্তরালে চিন কিন্তু গোটা আফ্রিকার সঙ্গেই সফল অর্থনৈতিক অংশীদারি গড়ে তুলছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চিনের সম্পর্কও ঠিক ‘সমানে সমানে’ বলা যাবে না, কিন্তু আফ্রিকার প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদকে ‘অবাধে বিশ্ববাজারে পৌঁছতে দেওয়ার’ অর্থাৎ আফ্রিকাকে তার নিজের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহ্য চিনের নেই, তাকে অবিশ্বাস করার পূর্বসংস্কারও আফ্রিকার নেই। সিরিয়ার গদ্দাফি এবং আইভরি কোস্টের গাবাগো, উভয়েই চিনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছিলেন। উভয়ের বিরুদ্ধেই সমরশক্তি প্রয়োগ করেছে ফ্রান্স। বাজার হারানোর ভয় এবং নতুন বাজার দখলের তাগিদ পুঁজির যে আন্তর্জাতিক সঙ্কট ঘনিয়ে তুলছে, আফ্রিকা মহাদেশকেই তার নিরসনের মল্লভূমিতে রূপান্তরিত করছে পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলি। কালো মানুষের আরও অনেক রক্তক্ষয় এই কৃষ্ণ মহাদেশে অপেক্ষা করে আছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.