শেষ রাতের এক দুর্ঘটনা যেন বেবাক করে দিয়েছে একটি থানাকে!
পথ-দুর্ঘটনার খবর পেলে আইনশৃ্ঙ্খলা রক্ষা করতে ছুটে যাওয়াই যাঁদের কাজ, সোমবার সকাল থেকে তাঁরাই পাথরের মতো মুখ করে সহকর্মীদের পরিবারের চেনা-অচেনা মুখগুলোকে সামলাচ্ছেন। ট্যাংরা থানার এই বাড়িটায় কত দিন-রাত একসঙ্গে কেটেছে। আজ ধনপতি, প্রবাল নেই। অন্য তিন সহকর্মী—তাঁরাও মৃত্যুর সঙ্গে যুঝছেন। হতাহতের তালিকায় থানারই পাঁচ অফিসার-কর্মী। ট্যাংরা থানার অফিসারেরা যেন কথা হারিয়ে ফেলেছেন।
সোমবার গভীর রাতে পার্ক স্ট্রিটে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ট্যাংরা থানার দুই পুলিশ অফিসারের। গুরুতর আহত আরও এক ব্যবসায়ী এবং ওই থানার তিন পুলিশকর্মী। তাঁদের একবালপুরের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তিন জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। থানা সূত্রে খবর, তাঁরা ‘অন-ডিউটি’তেই তল্লাশিতে বেরোন ওই ব্যবসায়ীর গাড়িতে। প্রশ্ন উঠেছে এই নিয়ে। |
দুর্ঘটনার পরে সেই গাড়ি। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র |
পুলিশ জানায়, মৃতদের নাম প্রবাল রায় (৪১) ও ধনপতি ঘোষ (৫০)। প্রবালবাবু ট্যাংরা থানার ‘সেকেন্ড অফিসার’ ছিলেন। ধনপতিবাবু ছিলেন ‘অ্যান্টি রাউডি অফিসার’। আহত হন সাব-ইনস্পেক্টর অমলকুমার ভট্টাচার্য (৫৫), দুই কনস্টেবল নিতাই ঘোষ (৪৯) ও দীপঙ্কর দে (৪৩) এবং ব্যবসায়ী মহম্মদ মুজফ্ফর (৩৭)। পুলিশ সূত্রের খবর, তাঁর বাড়ি ট্যাংরার মেহের আলি লেনে। তাঁর চামড়ার ব্যবসা। গভীর রাতে তাঁরই গাড়িতে ‘অন ডিউটি’-তে থাকা পাঁচ পুলিশকর্মী কোথায়, কী ‘তল্লাশি’তে গিয়েছিলেন, তাই নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ একটি সুইফ্ট ডিজায়ার গাড়ি চেপে পার্ক স্ট্রিট দিয়ে মল্লিকবাজারের দিকে যাচ্ছিলেন ওই ছ’জন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন প্রবালবাবু। পার্ক স্ট্রিট ও রডন স্ট্রিটের কাছে গাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকা কন্টেনার বোঝাই লরিতে ধাক্কা মারে। তাতে দুমড়ে-মুচড়ে যায় গাড়িটি। কিছুক্ষণ পরে পুলিশ ও স্থানীয় কয়েক জন প্রবালবাবুদের উদ্ধার করে এসএসকেএমে নিয়ে যায়। চিকিৎসকেরা প্রবালবাবু ও ধনপতিবাবুকে মৃত ঘোষণা করেন। বাকিদের বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, গাড়িটি প্রবল বেগে ছুটছিল। প্রবালবাবু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লরিতে ধাক্কা মারেন। লরির উপরে কন্টেনার থাকায় দুর্ঘটনায় বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।
পুলিশের এক সূত্রের দাবি, রবিবার রাতে পরিচিত ওই ব্যবসায়ীর গাড়িতে চেপে তল্লাশিতে বেরোন প্রবালবাবুরা। কোথায় তাঁরা তল্লাশি করতে যান এবং কেন এক ব্যবসায়ীর গাড়ি নিয়ে যাওয়া হল, তা রাত পর্যন্ত জানায়নি পুলিশ। তবে এটা পুলিশ জানিয়েছে, তল্লাশি সেরে বালিগঞ্জের একটি ধাবায় খেতে গিয়েছিলেন তাঁরা। সেখান থেকে খিদিরপুর। সেখান থেকে ফেরার পথে পার্ক স্ট্রিটে দুর্ঘটনা ঘটে। এ দিন বিকেলে ওই ব্যবসায়ীর পাড়ায় গিয়ে জানা গেল, ট্যাংরা থানার সঙ্গে বরাবরই ভাল সম্পর্ক রেখে চলেন মুজফ্ফর ওরফে পাপ্পু। পুলিশের ‘বন্ধু’ হিসেবেই তিনি এলাকায় পরিচিত। তাঁর প্রোমোটারির ব্যবসাও রয়েছে।
প্রশ্ন আরও, পার্ক স্ট্রিটে লরি দাঁড়িয়ে ছিল কী করে? পুলিশের একাংশের বক্তব্য, পার্ক স্ট্রিটে লরি দাঁড় করানোর নিয়ম নেই। কার মদতে লরিটি ওই রাস্তায় দাঁড় করানো হয়, তা খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে। কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপ আদক বলেন, “আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, নিয়ম ভেঙেই লরিটি দাঁড় করানো ছিল। সেই কারণে গাড়িটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সুরিন্দর রাম ও রামচন্দ্র রাম নামে দু’জন চালককে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
আদতে মালদহের বাসিন্দা ধনপতিবাবু স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে দমদম ক্যান্টনমেন্টের পি কে গুহ রোডে থাকতেন। ছোট ছেলে কুণাল বলেন, “রবিবার রাত দশটা নাগাদ বাবা ফোন করে জানায়, কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি চালানোর কাজ পড়ে গিয়েছে। রাতে বাড়ি ফিরতে পারবে না। তার পরে রাত পোহাতে খুব ভোরে বাবার দুর্ঘটনার খবর পাই।”
প্রবালবাবুর ঘনিষ্ঠেরা জানান, নিঃসন্তান এই অফিসার তপসিয়ার ফ্ল্যাটে প্রায় একাই থাকতেন। তাঁর স্ত্রী কর্মসূত্রে বেশির ভাগ সময়ই বিদেশে থাকেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তিনি দেশে ফিরছেন। এ দিন মর্গ থেকে প্রবালবাবুর দেহ নেন দাদা ইন্দ্রনীল রায়। তিনি বলেন, “আমি দিল্লিতে থাকি। দিন কয়েক আগে কলকাতায় এসে সন্তোষপুরে নিজের ফ্ল্যাটে উঠি। সোমবার ভোরে কসবা থানার এক অফিসার ফোনে দুঃসংবাদটা দিলেন।” |