সিনেমায় হয়।
অভিযুক্ত বেজায় প্রভাবশালী আর দোর্দণ্ডপ্রতাপ। তাই তাঁকে শনাক্ত করার সাহস দেখাতে পারেন না কোনও সাধারণ মানুষ। অন্তত প্রথম প্রথম পারেন না। বলিউডি বা টলিউডি ছবিতে আকছার এমনটা হয়।
হচ্ছে বাস্তবেও।
গার্ডেনরিচে পুলিশ অফিসার খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত, তৃণমূলের বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকে টিআই বা টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে শনাক্ত করার জন্য কোনও সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসতে চাইছেন না। সাক্ষী না-পেয়ে আতান্তরে পড়েছে সিআইডি। ১২ ফেব্রুয়ারি হরিমোহন ঘোষ কলেজের সামনে গণ্ডগোল, গুলি ও বোমাবাজি হয়। কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সেই ঘটনা ঘটেছে অনেকেরই চোখের সামনে। কিন্তু গোয়েন্দারা চেষ্টা চালিয়েও সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কোনও সাধারণ মানুষকে এখনও পর্যন্ত সাক্ষী হতে রাজি করাতে পারেননি। মুন্না এখন প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি। এই সপ্তাহের মধ্যেই তাঁকে শনাক্তকরণ প্যারেডে হাজির করানো হবে বলে আশা করছে সিআইডি। কিন্তু শনাক্ত করবে কে?
ভবানী ভবনের গোয়েন্দারা ইতিমধ্যেই পাহাড়পুর রোড এবং তার আশপাশের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও পথচারীদের বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, তার প্রমাণ আছে সে-দিনের ভিডিও ফুটেজে। কিন্তু গোয়েন্দারা সাক্ষী হতে বলায় প্রত্যেকেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, টিআই প্যারেডে মুন্নাকে শনাক্ত করার মতো দম তাঁদের নেই।
সিআইডি-র এক অফিসার বলেন, “প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েক জন আমাদের ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রলোভন দিয়েও লাভ নেই। আমাদের এমন প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছে যে, তদন্ত আর মামলা মিটে যাওয়ার পরে সিআইডি কি তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে আসবে?”
এর আগে মুন্নার দুই সহযোগী মহম্মদ ইবনে সাউদ ও তার ভাইপো শেখ সুহানকে শনাক্তকরণ প্যারেডে হাজির করানো হয়েছে। সুহানের গুলিতেই এসআই তাপসবাবু মারা যান বলে পুলিশের দাবি। মামলার নথি অনুযায়ী ইবনেও সে-দিন গুলি চালিয়েছিল। প্যারেডে ওই দু’জনকে শনাক্ত করার জন্যও সাক্ষী হিসেবে কোনও সাধারণ মানুষকে পাওয়া যায়নি। শুধু পুলিশকর্মীরাই টিআই প্যারেডে ওই দু’জনকে হামলাকারী হিসেবে শনাক্ত করেছেন।
একই ঘটনা ঘটেছে খুনের মামলা এবং সে-দিন দাঙ্গা বাধানোর মামলায় অভিযুক্ত, মুন্নার প্রতিপক্ষ মহম্মদ মোক্তারের টিআই প্যারেডেও। তাঁকে শনাক্ত করতে সাক্ষী হিসেবে হাজির ছিলেন শুধু পুলিশকর্মীরাই।
মোক্তার ও তাঁর সহযোগী মোস্তাক এবং মুন্নার দুই শাগরেদ ইবনে ও সুহানকে সোমবার আলিপুরে মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তোলা হয়। মোক্তার ও মোস্তাকের আইনজীবীরা তাঁদের মক্কেলদের জামিনের পক্ষে সওয়াল করে জানান, টিআই প্যারেডে মাত্র দু’তিন জন পুলিশ অফিসার মোক্তার ও মোস্তাককে শনাক্ত করেছেন। এ ছাড়া কোনও প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। সরকারি আইনজীবী শ্যামাদাস গঙ্গোপাধ্যায় জানান, ঘটনার দিন পুলিশকর্মীরাই ওঁদের কীর্তিকলাপ ভাল করে দেখতে পেয়েছেন। তা ছাড়া ধৃতেরা জামিনে মুক্তি পেলে তদন্তে তার প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন শ্যামাদাসবাবু। একই কারণ দেখিয়ে ইবনে-সুহানের জামিনের আবেদনেরও বিরোধিতা করা হয়। হাঙ্গামার মামলায় বিচারক চার জনকেই ১২ এপ্রিল পর্যন্ত জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
শুধু পুলিশের সাক্ষ্য যথেষ্ট নয় কেন? কেন দরকার সাধারণ সাক্ষী?
সিআইডি-র এক কর্তার কথায়, “ঘটনাস্থলে উপস্থিত কলকাতা পুলিশের বেশ কয়েক জন অফিসার ও কনস্টেবল এই মামলার সাক্ষী। কিন্তু নিহত ব্যক্তি যে-হেতু এক জন পুলিশ অফিসার, তাই পুলিশকর্মীরা এখানে এক পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কোনও সাধারণ লোককে দিয়ে টিআই প্যারেডে মুন্নাকে শনাক্ত করা গেলে মামলায় আমাদের অবস্থান আরও বেশি পোক্ত হত।”
৭ মার্চ মুন্নাকে বিহারের ডেহরি-অন-শোন স্টেশনের কাছ থেকে গ্রেফতার করা হলেও তাঁর ছেলে অনিলের এবং সানু-মিরাজের মতো তাঁর শাগরেদদের হদিস এখনও পায়নি সিআইডি। তাঁদের এই ব্যর্থতা যে এলাকার সাধারণ মানুষের ভীতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, গোয়েন্দারা প্রকারান্তরে তা স্বীকার করে নিচ্ছেন। আবার ওই অভিযুক্তদের ধরার জন্য প্রয়োজনীয় তল্লাশি অভিযানও বন্ধ রেখেছে সিআইডি। ফলে আমজনতার আতঙ্ক বেড়েই চলেছে।
তা হলে কী করবে সিআইডি? মুন্নার প্রতিপক্ষ মোক্তারের অনুগামী, অথচ গার্ডেনরিচে খুন বা হাঙ্গামার মামলা কোনওটাতেই অভিযুক্ত নন, এমন কাউকে সাক্ষী করে তাঁকে বা তাঁদের দিয়ে টিআই প্যারেডে মুন্নাকে শনাক্ত করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা। ছবিতে মুন্নার মতো কোনও অভিযুক্তকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার তোয়াক্কা না-করে শেষ পর্যন্ত পুলিশকে সাহায্য করতে হঠাৎই এগিয়ে আসেন কোনও আম-আদমি।
বাস্তবে মুন্নার বেলায় সিআইডি এমন কোনও পরিত্রাতা পায় কি না, সেটাই এখন দেখার। |