আইনজীবীদের হুটহাট ছুটি নেওয়ার প্রবণতা না-বদলানোয় তিনি যে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, সোমবার এজলাসে বসেই তা জানিয়ে দিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র। তাঁর মন্তব্য, “পৃথিবী বদলাচ্ছে। বিশ্বের মানুষ কাজ করতে চাইছে। ব্যতিক্রম কলকাতা হাইকোর্ট।”
কার্যত টানা পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পরে সোমবার আদালত খোলে। কিন্তু এ দিনই সকালে হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেয়, দুই আইনজীবীর মৃত্যুতে শোক জানাতে বেলা সাড়ে ১২টার পরে কোনও মামলায় যোগ দেওয়া হবে না। এই আর্জি নিয়ে বারের সম্পাদক ভাস্কর বৈশ্য প্রধান বিচারপতির কাছে গেলে তিনি বেঁকে বসেন। তিনি জানান, সাড়ে তিনটে পর্যন্ত হাইকোর্ট চলবে।
মাস ছয়েক আগে কলকাতা হাইকোর্টের দায়িত্ব নেওয়ার দিনই বিচারপতি মিশ্র আইনজীবীদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কাজের সময়ে কোনও অনুষ্ঠানের বিরোধী। হুটহাট ছুটি নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করার আর্জি জানিয়ে মাসের যে কোনও একটা দিনে বেলা সাড়ে তিনটার পরে প্রয়াত আইনজীবীদের জন্য শোকপ্রকাশ করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তিনি। আইনজীবীরা সেটা মেনেও নিয়েছিলেন। ভাস্করবাবুর কাছে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, সেই সিদ্ধান্ত বদল করা হচ্ছে কেন? ভাস্করবাবু বলেন, এটা ব্যতিক্রম।
ক্ষুব্ধ প্রধান বিচারপতি তখন গত বৃহস্পতিবার সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনজীবীর অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ তোলেন। বার অ্যাসোসিয়েশন প্রধান বিচারপতিকে জানিয়েছিল, হোলির কারণে যানবাহন কম থাকে বলে ওই দিন আইনজীবীরা আসতে পারবেন না। বিচারপতি
মিশ্র অসন্তোষ প্রকাশ করা সত্ত্বেও সে দিন হাইকোর্টে কার্যত কোনও কাজ হয়নি। প্রধান বিচারপতি ভাস্করবাবুকে বলেন, “গত বৃহস্পতিবার দোলের পরের দিনও আপনাদের অনেকে আদালতে আসেননি। বিচারপ্রার্থীদের কথা আপনাদের ভাবতে হবে। ওঁরা আপনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।”
কিন্তু বিচারপতি মিশ্রের নির্দেশ এ দিনও যে আইনজীবীরা মানছেন না, তা পরিষ্কার হয়ে যায় বেলা সাড়ে ১২টার পরে। প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে ধনেখালি থানার লকআপে নাসিরুদ্দিন মোল্লার মৃত্যু সংক্রান্ত জনস্বার্থের মামলাটি ছিল। ওই মামলার আবেদনকারীর আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য হাজির ছিলেন। কিন্তু সরকার পক্ষের কোনও আইনজীবী ছিলেন না।
অসন্তুষ্ট বিচারপতি মিশ্র বলেন, “এ সব আর কত দিন চলবে? এটা এখনই বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। গোটা দেশে কলকাতা হাইকোর্ট সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে। অন্য বিচারপতিরা
বার বার এই কাজ বন্ধ করায় ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। এর পর তাঁরা যদি কোনও কঠোর ব্যবস্থা নেন তা হলে কিছু করার থাকবে না। সুপ্রিম কোর্ট সব খবর রাখে। সুপ্রিম কোর্টকে আমি কী জবাবদিহি করব?”
ডিভিশন বেঞ্চের অপর বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী বলেন, “আমিও আইনজীবী ছিলাম। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। সারা দিন কাজ করে আইনজীবীরা তাঁদের এক দিনের উপার্জন যদি মৃতদের পরিবারের হাতে তুলে দিতেন, তা হলে প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখানো হতো।” বিচারপতি বাগচীর মতে, হাইকোর্টে ৬ লক্ষ মামলা বকেয়া। প্রতিদিন ২০০ করে নতুন মামলা দায়ের হচ্ছে। এই অবস্থায় এক মিনিট সময় নষ্ট করা অনৈতিক। অভিজ্ঞ ও প্রবীণ আইনজীবীদের নেতৃত্ব দিয়ে এ সব বন্ধ করা প্রয়োজন। এর পরেই তাঁর হতাশ মন্তব্য, “বিবেচনা যাঁদের আছে, তাঁরা এখন পিছনের সারিতে।”
আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “আমি যখন অন্য রাজ্যের হাইকোর্টে মামলা করতে যাই, তখন সেখানকার আইনজীবীরা বিদ্রুপের সুরে বলেন, আজ নিশ্চয় কলকাতা হাইকোর্ট বন্ধ।” এজলাসে তখন হাজির ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী জয়ন্ত মিত্র। তিনি বলেন, “একটু আগেই আমি হাইকোর্টের ৮ নম্বর এজলাসে অন্য একটি মামলার জন্য হাজির ছিলাম। ওই এজলাসে একটি মামলায় সওয়াল করার জন্য অন্য রাজ্যের এক জন আইনজীবী এসেছিলেন। তিনি দেখলেন সাড়ে ১২টার পরে বিচারপতি এজলাসে থাকলেও দু’পক্ষের আইনজীবী হাজির না-থাকায় মামলা হচ্ছে না। তাঁর কী ধারণা হল তা বুঝতেই পারছি।”
শুধু আইনজীবীর মৃত্যুতে কর্মবিরতি নয়, আরও বহু ছুতোনাতায় মাঝেমধ্যেই কাজ বন্ধ থাকে কলকাতা হাইকোর্টে। সম্প্রতি হাইকোর্টের দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলবে বলে পরের দিন ছুটি দাবি করেছিলেন আইনজীবীরা। প্রধান বিচারপতি না অনুমোদন না-করা সত্ত্বেও সে দিন আদালতে আসেননি বহু আইনজীবীই। প্রায় শূন্য এজলাসে বসেছিলেন বিচারপতিরা।
এ দিনও মধ্যাহ্ন বিরতির পরে বিচারপতিরা যে যাঁর এজলাসে বসেন। দেখা যায় কোনও মামলার এক পক্ষ আছেন, কোনও মামলার দু’পক্ষই নেই। আইনজীবী না-পেয়ে কোনও মামলার আবেদনকারী নিজেই নিজের কথা বলেন। তবে ধনেখালির মামলার মতো বড় মামলাগুলির শুনানি এ দিন আর হয়নি। |