পরীক্ষার্থী ৪৫ লক্ষ। তাঁদের সঙ্গী কমবেশি ৩০ লক্ষ অভিভাবক। রবিবার পথে নামা এই জনপ্লাবনে শেষ পর্যন্ত বহু পরীক্ষার্থীই যে নাকাল হলেন এবং রেললাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখালেন, তার জন্য পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে রাজ্য সরকার ও রেল।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার শেষে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য অভিযোগ করেন, রেলের অব্যবস্থার জন্যই বহু পরীক্ষার্থী ঠিক সময়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছতে পারেননি। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “রাজ্য সরকার আগেভাগে রেলকে সবই জানিয়েছিল। তা সত্ত্বেও অবিন্যস্ত রেল পরিষেবার কারণে অনেকের হয়রানি হয়েছে।” অভিযোগ মানতে চাননি রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। তিনি বলেন, “রাজ্য সরকার আমাদের কিছুই বলেনি। তা সত্ত্বেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমরা ছুটির দিনেও কাজের দিনের সময়সূচি মেনে ট্রেন চালিয়েছি। ট্রেনের যাতে দেরি না-হয়, সেই জন্য মেরামতিও বন্ধ রাখা হয়েছিল।”তা হলে পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে প্রার্থীদের হয়রানি কেন?
রেল প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য, বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী জড়ো হওয়ায় রাস্তায়, লেভেল ক্রসিংয়ে যানজট হয়েছে। রাস্তার যানজট নিয়ন্ত্রণ করা রেলের কাজ নয়। তিনি বলেন, “ট্রেনেও প্রচুর পরীক্ষার্থী ছিলেন। লেভেল ক্রসিংয়ের গেট খোলা রেখে তো ট্রেন চালানো সম্ভব নয়। দুর্ঘটনা ঘটলে রাজ্য কি তার দায় নেবে?”
বড়সড় দুর্ঘটনা না-ঘটলেও শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার বারুইপুর ও শাসন স্টেশনে তিন তরুণী-সহ সাত পরীক্ষার্থী ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে ওঠার সময় পড়ে গিয়ে আহত হন। তাঁদের মধ্যে দু’জনকে বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে স্থানান্তরিত করা হয় এম আর বাঙুর হাসপাতালে। হাওড়া-তারকেশ্বর লাইনের শেওড়াফুলিতে এবং মেন লাইনের মানকুণ্ডুতে আরও দু’জন পরীক্ষার্থী ট্রেনে ওঠার সময় পড়ে গিয়ে অল্পবিস্তর জখম হন।
দিনের সব চেয়ে বড় গোলমালটা হয়েছে বারুইপুরেই। ট্রেনে উঠতে না-পারা এবং পড়ে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের আহত হওয়ার ঘটনার জেরে বেলা ১১টা নাগাদ বারুইপুর স্টেশনে রেল অবরোধ শুরু হয়। জিআরপি অবরোধ তুলতে গেলে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি বেধে যায়। উত্তেজিত জনতা বারুইপুর জিআরপি থানা ও স্টেশন ম্যানেজারের অফিস ভাঙচুর করে। হাজারখানেক পরীক্ষার্থী বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। ইটপাটকেল ছোড়া হয়। পরিস্থিতি সামলাতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী বাহিনী নিয়ে সাড়ে ১২টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছন। পুলিশ পরীক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে বলেও অভিযোগ। বেলা দেড়টা নাগাদ অবরোধ ওঠে বলে পুলিশের দাবি।
শুধু বারুইপুর নয়, ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে উঠতে না-পারা পরীক্ষার্থীদের দিশাহারা দশা দেখা গিয়েছে শিয়ালদহ উত্তর, দক্ষিণ ও মেন শাখার প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই। লোকাল ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে ঠিকই। কিন্তু কোনও কামরাতেই তিলধারণের জায়গা ছিল না। দরজায় বাদুড়ঝোলা ভিড়। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আরও কয়েক হাজারের স্রোত। দু’-এক জন ঠেলেঠুলে উঠলেও বেশির ভাগই রয়ে যান স্টেশনে। কেউ কেউ চলন্ত ট্রেনেই ওঠার চেষ্টা করেন। সতর্ক করার জন্য গতি কমিয়ে হর্ন দিতে থাকেন গার্ড। এই ছবি দেখা গিয়েছে সকাল থেকেই।
ট্রেনে অতিরিক্ত ভিড় ও দুর্ঘটনার প্রতিবাদে বেলা ১১টা থেকে রেল অবরোধ শুরু হয় বিভিন্ন শাখায়। শিয়ালদহ দক্ষিণের লক্ষ্মীকান্তপুর-বারুইপুর, বনগাঁ শাখার বারাসত, হাবরা ও বসিরহাট শাখার সন্ডালিয়া স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়ে। ফলে ওই সব শাখায় অনেকেই সময়মতো পরীক্ষার হলে পৌঁছতে পারেননি।
পরীক্ষার্থীর ভিড় তো ছিলই। ভিড় বাড়ে তাঁদের অনেকের সঙ্গে থাকা অভিভাবকদের জন্যও। রেল ও পুলিশকর্তারা বলছেন, ৪৫ লক্ষ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে ৩০ লক্ষ অভিভাবক রাস্তায় নেমেছিলেন। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় প্রায় ৭৫ লক্ষ। এক রেলকর্তা বলেন, “এ দিনের ভিড় ছাপিয়ে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যাকেও!” আর সেই জনপ্লাবনেই বেধেছে গোলমাল। সেই প্লাবনে ভেসে যায় সড়ক ও রেলপথ।
জট পাকাল কী ভাবে?
মুর্শিদাবাদ পুলিশ সূত্রের খবর, ওই জেলার বেশির ভাগ পরীক্ষার্থীরই ১০০-১২০ কিলোমিটার দূরে আসন পড়েছিল। পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছনোর জন্য অনেকে সকাল ৮টা থেকেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ফলে অনেক রাস্তায় সাতসকালেই যানজট শুরু হয়। যানজট হয় অন্তত ছ’টি লেভেল ক্রসিংয়েও। আটকে যায় বহু ট্রেন। ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার জন্য পূর্ব রেল আগেই জানিয়েছিল, রবিবার সব লোকাল ট্রেন চালানো হবে। কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টা থেকেই শহরতলির স্টেশনগুলিতে মানুষের ঢল নামে। এক সময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, মাঝপথের কোনও স্টেশনে প্রায় কেউই আর ট্রেনেই উঠতে পারনেনি। ধৈর্য হারিয়ে বিক্ষোভে নেমে পড়েন পরীক্ষার্থীরা। তাঁদের অভিযোগ, রেল-কর্তৃপক্ষ বেশি ট্রেন চালাবেন বলে আশ্বাস দিয়েও চালাননি।
রেল অবশ্য জানিয়েছে, অন্যান্য দিনের মতো এ দিনও সব ট্রেন চালানো হয়েছে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে স্টেশনে এত বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থী ভিড় জমিয়েছিলেন যে, একটি ট্রেনে অত লোকের উঠতে পারার কথাই নয়। রেল সূত্রে বলা হয়েছে, একটি ট্রেনে দেড় থেকে দু’হাজার মানুষ যেতে পারেন। কিন্তু এ দিন তিন-চার হাজার পর্যন্ত পরীক্ষার্থী ট্রেনে ওঠার জন্য প্ল্যাটফর্মে হাজির হয়ে যাচ্ছিলেন। এবং কেউই অপেক্ষা করতে রাজি নন। কিন্তু একটি ট্রেনে একসঙ্গে এত মানুষ যাবেন কী ভাবে?
রেলের দাবি, এ দিন বারুইপুরে অবরোধের জন্য ৩৭টি লোকাল দেরিতে চললেও পরিস্থিতি সামাল দিতে ৩৬টি বিশেষ ট্রেনও চালানো হয়েছে। বারাসত লাইনে চালানো হয়েছে ১০টি বিশেষ ট্রেন। একটিও বাতিল করা হয়নি। ট্রেন চলাচলের জন্য যাঁদের দরকার, সেই সব কর্মী-অফিসারই নির্দিষ্ট স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন বলেও জানায় রেল। |