এ যেন টেট পরীক্ষার মহাকুম্ভ।
সাড়ে ছ’হাজার পরীক্ষাকেন্দ্র। ৪৫ লক্ষ পরীক্ষার্থী। পরিণাম যা হওয়ার, তা-ই হল। বাসে-ট্রেনে বাদুড়ঝোলা ভিড়। পরীক্ষাকেন্দ্রের ঠিকানা নিয়ে বিভ্রান্তি। সময়ে পৌঁছতে না পারায় অবরোধ ও বিক্ষোভ। ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে জখম।
রবিবারের টেট পরীক্ষা মোটের উপরে নির্বিঘ্নে হয়েছে বলে দাবি করেও তাই দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষা দেওয়ার একটা সুযোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “অনিবার্য কারণে যাঁরা পরীক্ষা দিতে পারেননি, তাঁরা যাতে পরে পরীক্ষা দিতে পারেন, সে জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে আইনি পরামর্শ নিতে বলেছি।”
প্রাথমিক স্কুলে ৩৫ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের পরীক্ষায় এ দিন প্রায় ৪৫ লক্ষ পরীক্ষার্থী ছিলেন। রাজ্য জুড়ে সাড়ে ছয় হাজার কেন্দ্রে ওই পরীক্ষা হয়। সময়সীমা ছিল বেলা ১টা থেকে ২টো। বহু পরীক্ষার্থীকেই দূরের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের আত্মীয়েরাও। একই সময়ে এত মানুষ গন্তব্যে পৌঁছনোর দৌড়ে সামিল, দুর্ভোগ তাই অপ্রত্যাশিত ছিল না। অভিযোগ, এই রাজসূয় যজ্ঞ সামলাতে পরিবহণ ব্যবস্থা যে ভাবে সাজানোর প্রয়োজন ছিল, তা দেখা যায়নি। তবে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের দাবি, পরীক্ষার আকার-আয়তনের কথা মাথায় রাখলে দুর্ভোগের পরিমাণ তত বড় নয়। ‘সুষ্ঠু’ ভাবে পরীক্ষা হওয়ার জন্য পরিবহণ-সহ সরকারের সব দফতরকে ধন্যবাদ জানান শিক্ষামন্ত্রী। দুর্ভোগ যা হয়েছে, তার জন্য মূলত রেলের অব্যবস্থাই দায়ী বলে রাজ্য প্রশাসনের দাবি।
পরীক্ষা শেষে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য অভিযোগ করেন, রেলে অব্যবস্থার জন্যই বহু পরীক্ষার্থী ঠিক সময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে পারেননি। বিশেষত, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ট্রেন বিভ্রাট এবং মুর্শিদাবাদে লেভেল ক্রসিং আটকে থাকায় পরীক্ষার্থীরা নাকাল হন। প্ল্যাটফর্মগুলিতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না, অনেককেই একাধিক ট্রেন ছেড়ে দিতে হয়েছে। ভিড়ের ঠেলায় পরীক্ষার্থীরা ট্রেনে উঠতেই পারেননি বারুইপুরে। শাসন, শেওড়াফুলি, মানকুণ্ডুতে ট্রেনে উঠতে গিয়ে পড়ে আহত হন অন্তত ১০ জন পরীক্ষার্থী। |
রবিবার সকালে এ রকমই ছিল বারাসত স্টেশনের অবস্থা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক। |
কিন্তু রেলের গাফিলতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেন, “রাজ্য সরকার আমাদের কিছু বলেনি। তা সত্ত্বেও আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজের দিনের সময়সূচি মেনে ছুটির দিনে ট্রেন চালিয়েছি।” পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের পাল্টা বক্তব্য, “রাজ্য সরকার সবই জানিয়েছিল। তা সত্ত্বেও অবিন্যস্ত রেল পরিষেবার কারণে অনেকের হয়রানি হয়েছে।” রাজ্য সরকার রেলকে দুষলেওবাস পাওয়া নিয়েও কিন্তু যথেষ্ট ঝামেলায় পড়তে হয়েছে পরীক্ষার্থীদের। সম্প্রতি বিধানসভায় পরিবহণমন্ত্রী স্বীকার করে নিয়েছিলেন, এ রাজ্যে ৭০ শতাংশ বাসই বসে গিয়েছে। রবিবার সেটাই হাড়ে-হাড়ে টের পেলেন পরীক্ষার্থীরা। প্রশাসনিক আশ্বাস সত্ত্বেও বেসরকারি বাস সে ভাবে ছিল না। ছিল না যথেষ্ট সরকারি বাসও। বহু পরীক্ষার্থীকে বাসের মাথায় উঠতে দেখা গিয়েছে। ট্রেকার, অটোতে জায়গা ছিল না। তাই পরীক্ষার্থীরা উঠেছেন মালবাহী গাড়িতেও। ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটস’-এর নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, জেলায় জেলায় প্রায় ৩০ হাজার বেসরকারি বাস চলত। কমতে কমতে সেই সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ হাজারে। ছুটির দিনে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজারে। এ দিন পরীক্ষা আছে জেনেও বাসের সংখ্যা বেশি বাড়েনি বলেই দাবি তপনবাবুর। তবে পরিবহণমন্ত্রী দাবি করেছেন, “এ দিন সরকারি বাস অন্য দিনের থেকে দেড় গুণ বেশি চলেছে।” সরকারি নিগমের এক কর্তার কথায়, “অন্য দিন ৪৫০ বাস চলে। এ দিন পরীক্ষার আগে-পরে ৮০০ বাস চালানোর চেষ্টা করেছি। এর বেশি বাস নেই।”
যানজটের ভোগান্তিও কম ছিল না। বহরমপুরের গির্জার মোড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন পরীক্ষার্থীরা। অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশকে কেন্দ্রের নিরাপত্তার কাজে পাঠানোয় যানজট হয়। জাতীয় সড়কে পুলিশের গার্ড রেল ভাঙচুর করেন বিক্ষোভকারীরা। পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। জেলাশাসক রাজীব কুমার বলেন, “পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্রাতিরিক্ত। এর ফলে জাতীয় সড়কে যানজট হয়। ট্রাফিক পুলিশ দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।” যান্ত্রিক গোলযোগে একটি লরি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় পশ্চিম মেদিনীপুরের কাঁসাই নদীর মোহনপুর সেতুর যানজটেও আটকেছেন অনেকে। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে সকাল ন’টায় যে যানজটের শুরু, তা কাটে দুপুর দু’টোয়। পরীক্ষার সময় তখন শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছু পরীক্ষার্থী জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ অফিসে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের পরে মেদিনীপুর কলেজে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও সকলে সেই সুযোগ পাননি। যানজট ছিল পানাগড়েও।
এত কাণ্ড করে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছেও হয়রানির শেষ নেই। পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে বহু পরীক্ষার্থী জানতে পারেন, ঠিকানা ভুল। তাঁদের অন্য কেন্দ্রে যেতে হবে। যেমন, বাদুড়িয়ার চণ্ডীপুরের বাসিন্দা শিউলি হালদার সকাল ন’টায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন পরীক্ষা দিতে। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল গোপালনগর থানার ঘোলা গার্লস হাইস্কুল। কিন্তু গোপালনগরে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, সেখানে ওই নামের কোনও স্কুল নেই। স্কুলটি আসলে ব্যারাকপুর মহকুমার ঘোলায়। তখন ঘড়িতে একটা বেজে গিয়েছে। আর তাঁর পরীক্ষা দেওয়া হল না। একই পরিস্থিতির শিকার বসিরহাট-২ ব্লকের চাঁপাপুকুর এলাকার আবু বক্কর সিদ্দিকি-সহ অনেকেই। আবু বক্করের ক্ষোভ, “পরীক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু পর্ষদের গাফিলতিতে সব শেষ হয়ে গেল।”
পর্ষদ প্রথমে জানিয়েছিল, বেলা ১টা ৫৫ মিনিটের মধ্যেও যাঁরা কেন্দ্রে ঢুকবেন, তাঁদের পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে। দেরিতে যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁদের আলাদা ঘরে বসিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু পর্ষদের এই ঘোষণা সময়মতো সব কেন্দ্রে পৌঁছয়নি। ট্রেনে দেরির কারণে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সপ্তগ্রাম হাইস্কুলে পৌঁছলেও স্কুল সমিতির কর্তারা তাঁদের পরীক্ষা দিতে দেননি বলে অভিযোগ পরীক্ষার্থীদের।
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, অনিবার্য কারণে পরীক্ষায় বসতে পারেননি যাঁরা, তাঁরা পরে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন। পর্ষদ সভাপতিও জানিয়েছেন, চেষ্টা সত্ত্বেও যাঁরা সঙ্গত কারণে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছতে পারেননি, তাঁদের জন্য ফের পরীক্ষা নেওয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু কারা সেই সুযোগ পাবেন, সেটা পুরো স্পষ্ট নয়। পশ্চিম মেদিনীপুরে যানজট, বারুইপুর থেকে দক্ষিণ-উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রেল চলাচলে বিভ্রাট এবং বহরমপুরে দীর্ঘক্ষণ রেলের লেভেল ক্রসিং আটকে থাকা পরীক্ষার্থীদের জন্যই ফের পরীক্ষার চিন্তা বলে জানান মানিকবাবু। অন্যান্য কারণে পরীক্ষা দিতে পারেননি যাঁরা, তাঁদের কী হবে? সভাপতি বলেন, “জেলাশাসকদের রিপোর্ট পেলে বিষয়টি দেখা হবে।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসু দাবি তুলেছেন, যাঁরা পরীক্ষা দিতে পারেননি, তাঁদের সবার জন্যই ফের পরীক্ষা নেওয়া হোক। আজ, সোমবার সব জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের দফতরে বিক্ষোভ দেখাবে ডিওয়াইএফআই। |