আত্মসম্মানবোধ। ইচ্ছাশক্তি। খুনে মানসিকতা। গুরুর মুখরক্ষার মরিয়া প্রয়াস - সব কিছুর যোগফল রহিম নবি।
ডেম্পো বক্সে চিলের মতো উড়ে এসে নিজে গোল করলেন। দ্বিতীয়ার্ধে ওডাফার গোলও এল মাঝমাঠ থেকে সোলো রানে, তাঁর বাড়ানো পাস থেকে। ওডাফা ছিলেন। ছিলেন টোলগেও। কিন্তু তাঁদের ছাপিয়ে সপ্তাহান্তের দুপুরে নায়ক করিম বেঞ্চারিফার ‘মাইকেল এসিয়েন’। যার জন্য মাঠ ফেরৎ জনতার স্লোগান, ‘খেললে নবি, ডেম্পো ছবি।’
লাজং ম্যাচে করমর্দনের দূরত্বে দাঁড়িয়ে গোল মিস করেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের বর্ষসেরা এই ফুটবলার। সেই আক্ষেপ থেকেই বলেছিলেন, “ডেম্পোর বিরুদ্ধে গোল করবই।” এ দিন অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিলেন সে কথা। কাদের বিরুদ্ধে? সাম্প্রতিক কালে যারা সবুজ-মেরুন জার্সির গাঁট। কটকে ২০১০ ফেডারেশন কাপে টাইব্রেকারে জেতার পর ডেম্পোর বিরুদ্ধে গত তিরিশ মাসে আর জয় পায়নি মোহনবাগান। দলকে জিতিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নবি বলছিলেন “অবনমন তাড়া করছে। আমি যে রহিম নবি, তা চেনাতে হবে তো।” তার পরেই জীবনের প্রথম এবং বর্তমান কোচকে টেনে এনে বললেন, “মুরারী শূর বলতেন, হারার আগে হেরো না। তাই কেঁপে যাইনি। আর করিমকে কিছু ফিরিয়ে দিতে হবে তো! বাবার অসুস্থতায় মানসিক কষ্টে থাকা লোকটা আমাদের জন্য কম খাটছে?” যা শুনে ময়দানে ‘দুটো ফুসফুস’ নিয়ে খেলে যাওয়া গৌতম সরকার বলছেন, “টিভিতে খেলাটা দেখলাম। নবিটা এ রকমই। তেরো বছর আগে মরিশাসে অনূর্ধ্ব-২৩ ভারতীয় দলের কোচ থাকাকালীন ওর এই জেদটাই চোখ টেনেছিল।” |
বাগানে স্বস্তি। গোল করে নবি ও ওডাফা। রবিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
নবিদের এই জেদ সম্বল করেই বাগান কোচ করিম ডেম্পোর বিরুদ্ধে টোলগে-ওডাফাকে আক্রমণে রেখে দল নামিয়েছিলেন ৪-৪-২ এ। স্নেহাশিস, মণীশদের মতো গতিসম্পন্ন মিডফিল্ডার না থাকায় এদিন আর ৪-৩-৩-এর রাস্তায় হাঁটেননি। দুই উইং হাফ নবি এবং সাবিথ শুরু থেকেই পালা করে আক্রমণে গিয়ে বিপক্ষের রক্ষণের ওপর চাপটা বজায় রাখলেন। দেবব্রত, মহেশ, সমীর, সুয়োকা-সহ প্রথম দলের সাত জন না থাকায় পাঁচ বারের আই লিগ জেতা কোচ আর্মান্দো স্নায়ুযুদ্ধে শুরু থেকেই কোনঠাসা। চিরশত্রু আর্মান্দোর দলকে এত দুর্বল অবস্থায় পেয়ে করিমও চনমনে। অ্যাওয়ে ম্যাচ থেকে এক পয়েন্ট নিয়ে যাওয়ার ছকে ডেম্পো কোচ দল নামিয়েছিলেন ৪-৫-১-এ। মাঠে সেটাই হয়ে যাচ্ছিল ৪-৪-১-১। কিন্তু আক্রমণে একা কোকো সাকিবোকে ধরে নিলেন দুরন্ত ফর্মে থাকা ইচে। ক্লাইম্যাক্সদের দ্বিতীয় বিদেশি জনি একটু পিছন থেকে খেলায় করিমের রক্ষণে স্বস্তিসূচক বাড়লেও শুরুতেই বাঁ দিক থেকে সাবিথের ক্রসে নবির গোলে অস্বস্তি বেড়ে গেল ডেম্পো রক্ষণে। ওডাফা-টোলগে-সাবিথ-নবির চর্তুভূজে তখন বেসামাল ক্রেসন-রোয়িলসনরা। আধা ফিট ওডাফা দু-দু’টি গোল মিস না করলে প্রথমার্ধেই ৩-০ এগিয়ে যাওয়ার কথা বাগানের। তবে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ক্রেসন গায়ে লেগে থাকা সত্ত্বেও নবির বাড়ানো বল থেকে গোল করতে ভুল করেননি সবুজ-মেরুন অধিনায়ক।
নবি যদি গোল করে কথা রেখে থাকেন, তা হলে নিজেদের বক্সে এরিয়াল বলে জায়গায় না থেকে ধারাবাহিকতা বজায় রাখল বাগান রক্ষণও। ডান দিক থেকে অ্যান্টনি পেরিরার ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে পিটার কার্ভালহো যখন ব্যবধান কমালেন, তখন জায়গায় ছিলেন না রাইট ব্যাক আইবর।
গোল করে গোল খাওয়ার পুরনো রোগ ফের দেখা দিয়েছে বুঝে করিম ঝটপট টোলগের জায়গায় কুইনটন এবং মেহরাজের জায়গায় নির্মলকে নামিয়ে দিলেন পাল্টা চাল। ওপরে ওডাফাকে রেখে বাগান তখন রক্ষণাত্মক ৪-৫-১। আইবর চলে গেলেন স্টপারে। রাইট ব্যাক নির্মল। বাকি সময়টা গরম, ক্লান্তি, পেশির টানকে সামনে রেখে সময় চুরি করেই ম্যাচ বের করে নেওয়া মোহনবাগানের। যা নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ ডেম্পো শিবির। তবে এই সময়টায় কোকোরা মরণকামড় দিলেও শেষ রক্ষা করতে ব্যর্থ।
সম্মানের ম্যাচ জিতে ১৮ ম্যাচে ১৩ পয়েন্ট ওডাফাদের ঘরে। কিন্তু লিগ তালিকায় গঙ্গাপারের ক্লাব সেই লাস্ট বেঞ্চেই। করিম তাই বলছেন, “কীসের আনন্দ? অবনমন বাঁচলে তখন আনন্দ করা যাবে।” আগামী রবিবার গোয়ায় বাগানের পরবর্তী প্রতিপক্ষ স্পোর্টিং ক্লুব দ্য গোয়া। আত্মবিশ্বাসী নবি বলছেন, “ওই ম্যাচটাও আমরা জিতব।” অবনমন আশঙ্কার মাঝে বাগানে এই জোশটাই এখন বসন্তের ফুরফুরে বাতাস।
মোহনবাগান: শিল্টন, আইবর, ইচে (ফানাই), মেহরাজ (নির্মল), বিশ্বজিৎ, নবি, ডেনসন, মণীশ মৈথানি, সাবিথ, টোলগে (কুইনটন), ওডাফা |