‘টেট’ না দিয়েই ফিরলেন অনেকে |
যানজটে আটকে গেল পরীক্ষার্থীদের ভাগ্য |
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
সমস্যায় পড়তে হতে পারে, এমন আশঙ্কা ছিল। কিন্তু তাই বলে যানজটের জেরে যে পরীক্ষা না দিয়ে ফিরতে হবে, এমনটা আশা করেননি কেউই। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ‘টেট’ পরীক্ষার জন্য সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েছিলেন মহা উৎসাহে। সব উৎসাহে জল ঢেলে দিল মেদিনীপুরে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে কংসাবতীর উপর মোহনপুর সেতুর যানজট। রবিবার সকাল পৌনে ন’টায় যে যানজটের শুরু, তা শেষ হল দুপুর দু’টোয়। সরকারি ভাবে পরীক্ষার সময় ততক্ষণে শেষ! |
|
|
মোহনপুর সেতুর কাছে আটকে পরীক্ষার্থীরা। |
বাদুরঝোলা হয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রের পথে। |
|
মাঝপথে দু’বার পরীক্ষা শুরুর সময় পিছনোও হয়। প্রথমে আধঘন্টা। পরে এক ঘন্টা। কিন্তু মাঝপথে আটকে থাকা পরীক্ষার্থীদের অনেকেই তা জানতে পারেননি। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। বেলা দেড়টায় ঝাড়গ্রামের বৈতা গ্রামের মণিচন্দনা পাত্রের খেদ, “সকাল ছ’টায় বেরিয়েছি। গাড়ি ভাড়া করে গ্রামের অনেকে একসঙ্গে এসেছি। ন’টা নাগাদ মোহনপুর সেতুর কাছে পৌঁছই। বেলা দেড়টায় দশ হাতও এগোতে পারিনি। পরীক্ষা না দিয়েই ফিরে যাচ্ছি।” যানজটে আটকে ক্ষুব্ধ নয়াগ্রামের নুপূর পাত্র। তিনি বলেন, “এসএসসি পাশ করেছি। কিন্তু কী হবে জানা নেই। তার উপর যানজটে আটকে এই পরীক্ষা দিতে পারলাম না।”গোটা পরিস্থিতির জন্য অবশ্য সরকারকেই দুষেছেন কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া। তাঁর বক্তব্য, “শিক্ষা দফতরের কোন দিগ্গজ এমন অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করেছিলেন তা ভেবে পাচ্ছি না। ১২০-১৩০ কিলোমিটার দূরে পরীক্ষা কেন্দ্র করার কী যুক্তি?” |
|
হেঁটেই মেদিনীপুর শহরে ঢুকছেন পরীক্ষার্থীরা। |
কেন সামলানো গেল না যানজট? পুলিশ সূত্রে খবর, কাঁসাইয়ের উপর মোহনপুর সেতুতে শনিবার গভীর রাতে একটি লরি যান্ত্রিক গোলযোগে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। লরিটি এক দিকে থাকায় অন্য দিক দিয়ে গাড়ি চলাচলে অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু এ দিন সকাল ন’টা নাগাদ পরীক্ষার্থী বোঝাই গাড়ির চলাচল ওই রাস্তায় এতটাই বেড়ে যায়, যা আঁচ করতে পারেনি পুলিশ-প্রশাসনও। প্রথমে তো এলাকায় কোনও পুলিশই ছিল না। ধর্মার মোড়ে মেদিনীপুরের মহকুমাশাসক অমিতাভ দত্ত প্রাণপণে পুলিশর সঙ্গে ট্রাফিক সামলানোর চেষ্টা করলেও ধর্মা থেকে মোহনপুর সেতু পর্যন্ত রাস্তায় পুলিশ নজরে পড়েনি। তৃণমূল নেতৃত্বও এ দিন বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প করেছিলেন। দলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়, শিবু পানিগ্রাহি, অর্ঘ্য চক্রবর্তী, সৌরভ বসুদেরও ধর্মাতে ট্রাফিক সামলাতে দেখা গিয়েছে। ঝাড়গ্রামের তৃণমূল নেতা দুর্গেশ মল্লদেব, প্রশান্ত রায়, টিএমসিপি নেতা রথীন্দ্রনাথ মণ্ডলরা শহরের পাঁচমাথা মোড়ে সহায়তা কেন্দ্র খুলে বসেছিলেন। দুর্গেশবাবুরা কয়েক হাজার পরীক্ষার্থীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তাতেও সকলের স্থান সংকুলান হয়নি। এই সুযোগে কেউ কেউ মোটা টাকার বিনিময়ে মোটর বাইকে করে পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছেন। |
|
ট্রেনে ওঠার জন্যও চলল লড়াই। |
জেলায় প্রায় ১ লক্ষ সাড়ে ৮২ হাজার পরীক্ষার্থী। সঙ্গে ছিলেন, প্রায় সম সংখ্যক অভিভাবক। বাসে যাতায়াতে অসুবিধে হতে পারে এই আশঙ্কায় বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীই গাড়ি ভাড়া করেছিলেন। এক একটি গাড়িতে একাধিক পরীক্ষার্থীও ছিলেন। পরীক্ষাকেন্দ্রগুলি এমন ভাবে ফেলা হয়েছিল যে, ঝাড়গ্রাম ও খড়্গপুর মহকুমার পরীক্ষার্থীদের যেতে হয়েছিলল মেদিনীপুর সদর ও ঘাটাল মহকুমাতে। আর ঘাটাল ও মেদিনীপুর সদর মহকুমার পরীক্ষার্থীদের যেতে হচ্ছিল ঝাড়গ্রাম ও খড়্গপুরে। এঁদের বেশিরভাগকেই যাতায়াত করতে হয়েছে মোহনপুর সেতু দিয়ে। সব মিলিয়ে দু’দিকে প্রায় ৮ কিলোমিটার জুড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরীর দাবি, “লরিটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দু’দিক থেকে একই সময়ে শ’য়ে শ’য়ে গাড়ি এসে যাওয়ায় যানজট হয়”। অবস্থা সামলাতে শেষমেশ পথে নামতে হয় পুলিশ-প্রশাসনের বড় কর্তাদের। পুলিশ সুপার ছাড়াও অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) রজতকুমার সাইনিকে দেখা যায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক সামলাচ্ছেন। যখন রাস্তা জটমুক্ত হয়, তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর দু’টো ছুঁয়েছে। অর্থাৎ পরীক্ষার সময় শেষ। পরীক্ষা না দিতে পেরে বেশ কিছু পরীক্ষার্থী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখান। তখনই সংসদ থেকে সময় বাড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে বাড়তি সময়ে পরীক্ষা হয়। মেদিনীপুর কলেজে বিশেষ পরীক্ষাকেন্দ্রও খোলা হয়েছিল। অবশেষে পরীক্ষাটা দিতে পেরে খুশি দীপিকা বাইরি, সুপ্রভ প্রহরাজেরা। |
|
পরীক্ষা শেষে |
মেদিনীপুর শহরের এই দুই বাসিন্দার পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল পিংলার গোবর্ধনপুর বালিকা বিদ্যালয়ে। বিশেষ পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়ার পর দু’জনেই বলেন, “পরীক্ষা ভাল হয়েছে। এতদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। পরীক্ষাটা দিতে পারব না ভেবে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম। এখন ভাল লাগছে।” পিংবনিতে পরীক্ষাকেন্দ্র এমন জনা তিরিশেক পরীক্ষার্থীকে তিনটে নাগাদ পৌঁছনোয় পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্য দিকে দাঁতন ২ ব্লকের গড়হরিপুর হাইস্কুলে সাড়ে তিনটে নাগাদ আসা ১৮ জন পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়েছে। ছুটির দিন হলেও ‘টেট’ পরীক্ষার জেরে এ দিন ট্রেনে-বাসে ছিল বাদুড়ঝোলা ভিড়। পরীক্ষার্থীরা ছাড়াও ভোগান্তিতে পড়েন আমজনতা। ক্ষীরপাই থেকে বাসে করে খড়্গপুর আসছিলেন রাজেশ বাগ। তাঁর কথায়, “সকাল ৭টায় বাসে চেপেছিলাম। খড়্গপুর ঢুকতে বিকেল ৩টে বেজেছে।” গোলমালের মধ্যে এক পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। অভিযোগ, এ দিন যানজটের মধ্যে ধর্মাচকে দাঁড়িয়ে ওই যুবক মোবাইলে প্রশ্ন-উত্তর বলাবলি করছিলেন। মহকুমাশাসক অমিতাভ দত্তের সামনেই ঘটে ঘটনাটি। মহকুমাশাসকের নির্দেশে কোতয়ালি থানার পুলিশ ওই যুবককে গ্রেফতার করে। ওই যুবক কাকে, ঠিক কী বলছিলেন, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে এক পরীক্ষার্থীর মোবাইল ও টাকা খোওয়া যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সোমদত্তা মুখোপাধ্যায়ের পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল মেদিনীপুর কলেজিয়েট (বালক) স্কুলে। বারান্দায় ব্যাগ রেখে ভেতরে ঢুকেছিলেন। সোমদত্তা বলেন, “পরীক্ষা শেষে বেরিয়ে দেখি ব্যাগের ভেতরে থাকা দু’টি মোবাইল নেই। পার্স খুলে টাকাও নিয়ে নিয়েছে দুষ্কৃতী।” সব মিলিয়ে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় এমন দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা সাম্প্রতিক অতীতে হয়নি।
|
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ, কিংশুক আইচ এবং সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
|