নরপিশাচেরা শুধু রাজধানী দিল্লিতে নাই, উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রত্যন্ত মেঘালয়েও আছে। মেঘালয়ের পূর্ব গারো হিল জেলার উইলিয়ামনগরে নবম শ্রেণির পড়ুয়া ষোলো বছরের এক নাবালিকার উপর সতেরোটি পুরুষ মিলিয়া যে নারকীয় অত্যাচার করিয়াছে, তাহার সুযোগ মেলে মেয়েটির স্থানীয় উৎসব দেখিয়া সবান্ধব বাড়ি ফিরিবার সময়। এই নৃশংস যৌন নির্যাতন অবশ্য দেশের কোথাও কোনও প্রতিবাদী ঢেউ তোলে নাই। দিল্লির ধর্ষিতার পাশে যেমন সমগ্র দেশ সমাবেশিত হয়, মেঘালয়ের ক্ষেত্রে তাহার বিপরীত চিত্র কেন? কেন ওই অসহায় নির্যাতিতা বালিকাটির স্কুল কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত তাহাকে আর বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিতে দিল না? কেন পাড়া-প্রতিবেশীরা পর্যন্ত তাহাকে সপরিবার বিতাড়িত করিয়া ছাড়িল? বদনামের ভয়ে? বদনাম তো হওয়ার কথা ধর্ষকদের, যাহারা অপকর্মটি সংঘটন করিয়াছে, তাহার বদলে বদনামের ভাগীদার হইবে সেই অসহায় ধর্ষিতা, যাহার এ ক্ষেত্রে করণীয় কিছুই ছিল না? যে-সমাজের বিধান এমন, তাহাকে মাথায় করিয়া রাখিতে হইবে? এই প্রতিবেশীদের ভালবাসিতে হইবে? ধ্বংস কামনা না করিয়া ইহাদের শুভ ও মঙ্গল চাহিতে হইবে? উত্তর-পূর্বের অন্যান্য জনজাতীয় রাজ্যের মতো মেঘালয়ের সমাজও নাকি মাতৃতান্ত্রিক, যেখানে মহিলারা সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী? ধর্ষিতা নাবালিকার সহিত সেই মাতৃতন্ত্র যে আচরণ করিল, মনু-পরাশরের পিতৃতান্ত্রিক বর্বরতাও তাহা অনুমোদন করে না।
মেঘালয়ের দায়িত্ব ছিল অপকাণ্ডটিকে জাতীয় প্রচারের আলোয় তুলিয়া আনা। যে-রাজ্যে সদ্য নির্বাচিত হইয়াছেন চার মহিলা বিধায়ক, যাঁহাদের মধ্যে তিন মহিলা হাসিল করিয়াছেন মন্ত্রিত্ব, সদ্য রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রিত্বে বৃত হইয়াছেন একজন মহিলা এবং প্রধান বিচারপতির গুরুদায়ও বর্তাইয়াছে এক মহিলার উপর, সেই রাজ্য তাহারই এক ষোড়শী কন্যার উপর সতেরোটি বর্বরের নিগ্রহ লইয়া কার্যত মৌনী রহিয়া গেল? নীরব থাকিল সংবাদমাধ্যম, নির্বাক রহিয়া গেলেন শিলঙ সহ উত্তর-পূর্বের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি, দেশের বিদ্বৎসমাজ, বুদ্ধিজীবীকুল? তাহা কি এই জন্য যে বর্বরতায় অভিযুক্তদের মধ্যে রাজ্যের দুই মন্ত্রীর আত্মীয়রাও রহিয়াছে? অসম্ভব নয়। দিল্লির গণধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্তরা সকলেই ছিল নিম্নবর্গীয় সাধারণ মানুষ, রাজনীতি কিংবা ব্যবসায় জগতের প্রভাবশালী কেউকেটা নয়। তেমন হইলে কী ঘটে, অভিযুক্তরা কী ভাবে জামিন পায়, প্যারোলে মুক্ত হইয়া জনারণ্যে গা ঢাকা দেয়, সাক্ষীর অভাবে কেমন করিয়া প্রকাশ্য জনস্থানে অপকর্ম করিয়াও আইনের বিচারে খালাস পায়, তাহার ভূরি ভূরি নজির আছে। মেঘালয়ের কন্যাটির জন্য সে জন্যই কি দেশে কোনও সহানুভূতির ঢেউ উঠিল না, নির্যাতকদের বিরুদ্ধে উঠিল না ঘৃণা ও ধিক্কারের ঐকতান? সুস্থভাবে বাঁচিয়া থাকার লড়াইয়ে কাহাকেও পাশে না পাইলে এই কন্যারা কেমন করিয়া যথাযথ জীবন ফিরিয়া পাইবে? সরকার ধর্ষিতাদের জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করিতে পারে, সমাজ নির্মম থাকিলে তাহা সরকারি প্রকল্পই থাকিবে। |